উত্তম আচরণের মাধ্যমে হক্ব জানিয়ে দেয়া বা উপদেশ প্রদান করা হ’ল কল্যাণকামিতা। কেননা, আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَ لَا تَسۡتَوِی الۡحَسَنَۃُ وَ لَا السَّیِّئَۃُ ؕ اِدۡفَعۡ بِالَّتِیۡ هِیَ اَحۡسَنُ فَاِذَا الَّذِیۡ بَیۡنَکَ وَ بَیۡنَهٗ عَدَاوَۃٌ کَاَنَّهٗ وَلِیٌّ حَمِیۡمٌ ‘ভাল আর মন্দ সমান নয়। উৎকৃষ্ট দিয়ে মন্দকে দূর কর। তখন দেখবে, তোমার আর যার মধ্যে শত্রুতা আছে সে যেন অন্তরঙ্গ বন্ধু’ (হা-মিম-সাজদা ৪১/৩৪)।
এখানে অতীব গুরুত্বপূর্ণ এক চারিত্রিক শিক্ষা যে, মন্দকে দূরীভূত কর ভাল দ্বারা। যা উৎকৃষ্ট তা দিয়ে নিকৃষ্ট প্রতিহত কর। অর্থাৎ, অন্যায়ের বদলা নাও ন্যায় প্রতিষ্ঠা করে, যুলুমের বদলা নাও ক্ষমা করে, ক্রোধের বদলা নাও ধৈর্যধারণ করে, বেআদবীর বদলা নাও দৃষ্টিচ্যুত করে এবং মূর্খতা বা অশ্লীল কথার উত্তর দাও সহ্য করে নীরব থেকে। এর ফল এই হবে যে, তোমার শত্রু দেখবে তোমার বন্ধু হয়ে গেছে। তোমার থেকে দূরে দূরে থাকত এমন ব্যক্তি তোমার নিকটে হয়ে যাবে এবং তোমার রক্ত-পিপাসু ব্যক্তি তোমার বশীভূত ও প্রেম-পিপাসু হয়ে যাবে।
একজন ব্যক্তির জন্য অতিব আবশ্যক হলো তার উর্দ্ধতন, সমপর্যায় ও নিম্ন পর্যায়ের ব্যক্তিদের সৎ কাজের আদেশ দেওয়া, যখন এর দ্বারা উদ্দেশ্য হবে কল্যাণকামিতা; কাউকে নিন্দা করা নয়। রাসূল (সা.)-এর জীবনে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা থেকে উক্ত আয়াতের সঠিক ব্যাখ্যা পেতে পারি।
আব্দুল্লাহ বিন সালাম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: “মহান আল্লাহ যখন যাইদ বিন সা‘নাহ রাদ্বিয়াল্লাহুকে হিদায়াত দিতে চাইলেন, তখন যাইদ বিন সা‘নাহ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন: “নবুওয়াতের যত আলামত আছে, সবগুলোই আমি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর চেহারা দেখে চিনতে পেরেছি, দুটি আলামত ব্যতিত, যা আমি তাঁর মাঝে এখনও পরখ করে দেখিনি। (আলামত দুটি হলো:) অজ্ঞতাপূর্ণ আচরণের উপর তাঁর ধৈর্য-সহিষ্ণুতা অগ্রগামী হবে। তাঁর সাথে চরম অজ্ঞতাপূর্ণ আচরণ করা হলেও এতে তাঁর ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা বৃদ্ধিই পাবে। ফলে আমি ইচ্ছা করলাম যে, আমি তাঁর সাথে নম্রতার সাথে আচরণ করবো, যাতে আমি তাঁর সাথে মিশে তাঁর ধৈর্য ও অজ্ঞতাপূর্ণ আচরণ সম্পর্কে অবগত হতে পারি।” তিনি বলেন: “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্বীয় হুজরা থেকে বের হলেন তাঁর সাথে আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ছিলেন। এমন সময় গ্রাম্য লোকের মত এক ব্যক্তি তার বাহনে চড়ে তাঁর কাছে আসলেন এবং তাঁকে বললেন: “হে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, ওমুক জনপদের লোকজন মুসলিম হয়েছেন এবং তারা ইসলামে প্রবেশ করেছেন, আমি তাদেরকে জানিয়েছিলাম যে, যদি তারা ইসলাম গ্রহণ করে, তবে স্বাচ্ছন্দে তাদের কাছে রিযক আসবে কিন্তু তাদেরকে দুর্ভিক্ষ ও অনাবৃষ্টি পেয়ে বসেছে! হে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, আমি আশংকা করছি যে, তারা যেভাবে একটা আশায় ইসলামে প্রবেশ করেছিল, অনুরুপভাবে তারা ইসলাম থেকে বের হয়ে যাবে! যদি আপনি উপযুক্ত মনে করেন, তবে আপনি তাদের কাছে এমন কিছু পাঠান, যা তাদেরকে এই ব্যাপারে সহযোগিতা করতে পারবে।” অতঃপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর পাশের এক ব্যক্তির দিকে তাকালেন, আমার ধারণা তিনি উমার রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ছিলেন। তিনি বললেন: “হে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, আমি কাছে তো এমন কিছুই অবশিষ্ট নেই।”
যাইদ বিন সা‘নাহ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বললেন: “হে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, ওমুক গোত্রের বাগানের নির্দিষ্ট পরিমাণ খেজুর এতো দিনের মধ্যে পরিশোধের শর্তে আমার কাছে বিক্রি করবেন কি?” রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন: “জ্বী, না। হে ইয়াহুদি, আমি তোমার কাছে নির্দিষ্ট পরিমাণ খেজুর এতো দিনের মধ্যে পরিশোধ করার শর্তে বিক্রি করবো তবে ওমুক গোত্রের বাগান নির্দিষ্ট করবো না।” যাইদ বিন সা‘নাহ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বললেন: “জ্বী, ঠিক আছে।” ফলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমার সাথে ক্রয়-বিক্রয় চুক্তি করলেন। ফলে আমি আমার থলে খুলে আশি মিসকাল বের করে তাঁকে দিলাম এজন্য যে, তিনি নির্দিষ্ট পরিমাণ খেজুর এতো দিনের মধ্যে আমাকে পরিশোধ করবেন। অতঃপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেগুলি ঐ ব্যক্তি দিয়ে বললেন: “এগুলি তুমি দ্রুত তাদের কাছে নিয়ে যাও এবং এগুলি দ্বারা সাহায্য করো।” যাইদ বিন সা‘নাহ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন: “মেয়াদ শেষ হওয়ার দুই অথবা তিন দিন পূর্বে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একজন আনসারী ব্যক্তির জানাযার উদ্দেশ্যে বের হলেন, এসময় তাঁর সাথে আবু বকর, উমার, উসমান ও অন্যান্য একদল সাহাবী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম ছিলেন। যখন তিনি জানাযার সালাত আদায় করেন, তখন তিনি একটি দেয়ালের কাছে আসেন এবং সেখানে বসেন। আমি তাঁর জামার আঁচল ধরে তাঁর দিকে কড়া দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললাম: “হে মুহাম্মাদ আপনি কি আমার হক পরিশোধ করবেন না? আল্লাহর কসম! হে আব্দুল মুত্তালিবের বংশ, আপনাদের ঋণ পরিশোধ করতে টালবাহনা করার ব্যাপারটি আমার জানা ছিল না। কারণ আমি আপনাদের লেন-দেন সম্পর্কে জানি।” তিনি বলেন, আমি উমার বিন খাত্তাব রাদ্বিয়াল্লাহুর দিকে তাকিয়ে দেখলাম, তাঁর চোখ দুটি রাগে আবর্তনশীল নক্ষত্রের মতো আবর্তিত হচ্ছে! তিন আমার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন: “হে আল্লাহর শত্রু! তুমি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে এমন কথা বললে, যা আমি শুনতে পেলাম এমন কাজ করলে যা আমি দেখলাম? যদি আমি তাঁর সম্মানের খেয়াল না করতাম, তবে আমার এই তরবারী দিয়ে তোমার গর্দানে মারতাম! রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শান্ত ও ধীরস্থিরভাবে উমার রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর তাকিয়ে থাকলেন তারপর বললেন: “আমরা তোমার থেকে এর থেকে ভ্ন্নি আচরণের বেশি মুখাপেক্ষী ছিলাম যে, তুমি আমাকে উত্তমভাবে ঋণ পরিশোধ করতে এবং তাকে তা মেনে নেওয়ার আদেশ দিতে। হে উমার, তাকে নিয়ে যাও, তার হক পরিশোধ করে দাও এবং তুমি যে তাকে ভয়-ভীতি দেখিয়েছো সেজন্য তাকে বিশ সা‘ বেশি দাও।”
যাইদ বিন সা‘নাহ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, অতঃপর উমার রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু আমাকে নিয়ে গেলেন এবং আমার পাওনা পরিশোধ করলেন এবং অতিরিক্ত আরো বিশ সা‘খেজুর দিলেন। আমি বললাম: “এই অতিরিক্ত খেজুর কিসের জন্য?” তিনি বলেন: “ আমি যে তোমাকে ভয়-ভীতি দেখিয়েছি সেজন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে আরো বিশ সা‘ খেজুর বেশি দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।” আমি বললাম: “হে উমার রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু আপনি কি আমাকে চিনেন? “ তিনি বললেন: “না, কে তুমি?” আমি বললাম: “ আমি যাইদ বিন সা‘নাহ।” তিনি বললেন: ইয়াহুদী পন্ডিত?” আমি বললাম: “জ্বী, হ্যাঁ, ইয়াহুদি পন্ডিত।” তিনি বলেন: “তুমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে এমন কথা কেন বললে, তাঁর সাথে এমন আচরণ কেন করলে?” আমি বললাম: “হে উমার রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু, নবুওয়াতের সমস্ত আলামত আমি তাঁর চেহারা থেকে চিনতে পেরেছি, দুটি আলামত ব্যতিত, যা আমি তাঁর মাঝে পরীক্ষা করে দেখি নাই। (আলামত দুটি হলো:) অজ্ঞতাপূর্ণ আচরণের উপর তাঁর ধৈর্য-সহিষ্ণুতা অগ্রগামী হবে। তাঁর সাথে চরম অজ্ঞতাপূর্ণ আচরণ করা হলেও এতে তাঁর ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা বৃদ্ধিই পাবে। এই দুটি বিষয় এখন আমি পরীক্ষা করলাম।
হে উমার রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু, আপনাকে সাক্ষী রেখে বলছি, আমি আল্লাহকে রব হিসেবে, ইসলামকে দ্বীন হিসেবে এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে নাবী হিসেবে পেয়ে সন্তুষ্ট। আমি আপনাকে সাক্ষী রেখে বলছি আমি আমার অর্ধেক সম্পদ –আমি তো প্রচুর সম্পদের মালিক- মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর অনুসারীদের জন্য দান করে দিলাম।” উমার রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন: “তুমি বরং বলো, “কিছু অনুসারীর জন্য দান করে দিলাম। কারণ তাদের সবাইকে দান করতে পারবে না।” আমি বললাম: “তার কিছু অনুসারীর জন্য দান করে দিলাম।” অতঃপর উমার ও যাইদ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কাছে গেলেন। অতঃপর যাইদ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন: أَشْهَدُ أَنْ لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَسُولُهُ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَآمَنَ بِهِ وصدَّقه وَشَهِدَ مَعَ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَشَاهِدَ كَثِيرَةً ثُمَّ تُوُفِّيَ فِي غَزْوَةِ تَبُوكَ مُقْبِلًا غَيْرَ مُدْبِرٍ “আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া প্রকৃত কোন মা‘বুদ নেই এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর বান্দা ও রাসূল।” তিনি তাঁর প্রতি ঈমান আনেন, সত্যায়ন করেন এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাথে অনেক যুদ্ধে শরীক হন। তারপর তাবুক পশ্চাৎগামী হওয়ার পরিবর্তে অগ্রগামী হয়ে জিহাদ করে শাহাদাত বরণ করেন।” মহান আল্লাহ যাইদের প্রতি রহম করুন। তিনি এই হাদীস বর্ণনা করেছেন। তারপর আমি ওয়ালিদকে বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন আমাকে পুরো হাদীসটি বর্ণনা করেছেন মুহাম্মাদ বিন হামযা, তিনি তাঁর পিতা ও দাদার সূত্রে আব্দুল্লাহ বিন সালাম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন।”
(ছহীহ ইবনে হিব্বান হা/২৮৮, বায়হাকী হা/১১০৬৬, মুস্তাদারক হাকিম হা/৬৫৪৭। ইমাম হাকিম (রাহিমাহুল্লাহ) হাদীসটিকে ‘ছহীহ’ বলেছেন।