(সূরা আনআমের ৬/১১৫ নং আয়াতের অপব্যাখ্যার জবাব লিখিত ভাবে দিলাম)
আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَتَمَّتْ كَلِمَتُ رَبِّكَ صِدْقًا وَعَدْلًا لَا مُبَدِّلَ لِكَلِمَاتِهِ ‘‘আর সত্য ও ন্যায়ের দিক দিয়ে আপনার রব-এর বাণী পরিপূর্ণ। তাঁর বাক্যসমূহ পরিবর্তনকারী কেউ নেই’’ (আনআম ৬/১১৫)।
(১) আল্লাহ বলেন, আর সত্য ও ন্যায়ের দিক দিয়ে আপনার রব-এর বাণী পরিপূর্ণ।
এখানে যা বুঝানো হয়েছে…. আল্লাহর কথা বা বাণী বা কালাম সত্যতা, ইনসাফ ও সমতার দিক দিয়ে সম্পূর্ণ। এর মাঝে কোন প্রকার ফাঁক ফোকর নেই। বান্দা যেকোন ভাবে এর মাঝে অসত্য, বেইনসাফ, অন্যায়, যুলুম, অসঙ্গতি, অপূর্ণতা প্রভৃতি দেখাতে পারবে না। কেননা আল্লাহ সূরা বাক্বারাহর প্রথমেই বলেছে, এটা সেই কিতাব যার মধ্যে কোন প্রকান সন্দেহ নেই। তিনি আরোও বলেন, তোমরা অনুরূপ একটি সূরা তৈরী করো যদি তোমরা সত্যবাদী হও।
রাব্বুল আলামিন এই জন্য এসব চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন যে, বান্দা কোনরূপ সন্দেহ বা অপূর্ণতা খুঁজে দেখাতে পারে। কিন্তু আল্লাহ সূরা আনআমের উক্ত আয়াতে যথাযথ বললেন আমার কথা ন্যায় ও সততা দ্বারা পরিপূর্ণ। অতপর এগুলোতে কোনরূপ ভ্রান্তির সম্ভাবনা নেই। عدل এর সম্পর্ক দ্বিতীয় প্রকার অর্থাৎ বিধানের সাথে। উদ্দেশ্য এই যে, আল্লাহ তা’আলার সব বিধান عدل তথা ন্যায়বিচার ভিত্তিক। [ইবন কাসীর] অতএব, আয়াতের উদ্দেশ্য এই যে, আল্লাহর বিধান সুবিচার ও সমতার উপর ভিত্তিশীল। এতে কারো প্রতি অবিচার নেই এবং এমন কোন কঠোরতাও নেই যা মানুষ সহ্য করতে পারে না। অন্য এক আয়াতে বলা হয়েছেঃ (لَا يُكَلِّفُ اللَّهُ نَفْسًا إِلَّا وُسْعَهَا) অর্থাৎ “আল্লাহ ক্ষমতা ও সামর্থ্যের বাইরে কারো প্রতি কোন বাধ্যবাধকতা আরোপ করেননি”। [সূরা আল-বাকারাহ ২/২৮৬]
পূর্বেই বলেছি কারু প্রতি আল্লাহ যুলুম করেননি। কেননা দ্বীন ন্যায় ও সততা দ্বারা পরিপূর্ণ । এছাড়াও আমরা বলে থাকি, দ্বীন ইসলাম হ’ল পরিপূর্ণ জীবন বিধান ()। সেই লক্ষ্যে কুরআনে বর্ণিত অতীত ও ভবিষ্যতের ঘটনাবলী, পুরস্কারের ওয়াদা ও শাস্তির ভীতি-প্রদর্শন সবই সত্য; এসব ব্যাপারে বিন্দুমাত্র সন্দেহের অবকাশ নেই। কুরআন বর্ণিত যাবতীয় বিধান সমগ্র বিশ্ব ও কেয়ামত পর্যন্ত আগমনকারী বংশধরদের জন্য সুবিচার ও সমতাভিত্তিক, এগুলোতে কারো প্রতি কোনরূপ অবিচার নেই এবং সমতা ও মধ্যবর্তিতার চুল পরিমাণও লঙ্ঘন নেই। কুরআনের এ বৈশিষ্ট্য আরো প্রকৃষ্টভাবে প্রমাণ করে যে, কুরআন আল্লাহর কালাম।
(২) তার পরেই আল্লাহ বলেন, ‘তাঁর বাক্যসমূহ পরিবর্তনকারী কেউ নেই’।
এখানে যা বুঝানো হয়েছে…. কুরআনের আরো একটি বৈশিষ্ট্য এই যে, (لَا مُبَدِّلَ لِكَلِمَاتِهِ) অর্থাৎ আল্লাহর কালামের কোন পরিবর্তনকারী নেই।’ তিনি যেটা যে সময়ে হবে বলেছেন সেটা সে সময়ে অবশ্যই অনুষ্ঠিত হবে। সেটাকে রদ বা পরিবর্তন করার কোন ক্ষমতা কারো নেই। [তাবারী]
ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা এর অর্থ বলেন, আল্লাহর ফয়সালাকে কেউ রদ করতে পারবে না। তার বিধানকে পরিবর্তন করার অধিকার কারও নেই। অনুরূপভাবে তাঁর ওয়াদার বিপরীতও হবার নয়। [বাগভী]
পরিবর্তনের এক প্রকার হচ্ছে যে, এতে কোন ভুল প্রমাণিত করার কারণে পরিবর্তন করা। পূর্ব আয়াতে আল্লাহর কালামকে পূর্ণ বলার কারণে কারো মনে আসতে পারে যে, কোন কিছু পূর্ণ হওয়ার পর তাতে কি আবার অপূর্ণাঙ্গতা আসবে? এ রকম প্রশ্নের উত্তর এখানে দেয়া হয়েছে। আর পরিবর্তনের দ্বিতীয় প্রকার হচ্ছে জবরদস্তিমূলকভাবে পরিবর্তন করা। যেমন এর পূর্বে তাওরাত ও ইঞ্জলকে পরিবর্তন করা হয়েছে। আল্লাহর কালাম এ সকল প্রকার পরিবর্তনেরই ঊর্ধ্বে। আল্লাহ তা’আলা স্বয়ং ওয়াদা করেছেনঃ (إِنَّا نَحْنُ نَزَّلْنَا الذِّكْرَ وَإِنَّا لَهُ لَحَافِظُونَ) অর্থাৎ “আমরাই এ কুরআন নাযিল করেছি এবং আমরাই এর সংরক্ষক।” সূরা আল-হিজর: ৯]
কুরআনের উপর দিয়ে চৌদ্দশত বছর অতিবাহিত হয়ে গেছে। প্রতি শতাব্দি ও প্রতি যুগে এর শক্রদের সংখ্যাও এর অনুসারীদের তুলনায় বেশী ছিল; কিন্তু এর একটি যের-যবর পরিবর্তন করার সাধ্যও কারো হয়নি।
তর্কে খাতিরে কুরআন-সুন্নাহর অপব্যাখ্যা করা যাবে না। আব্দুল্লাহ ইবনু আমর (রাঃ) বলেন, ‘কিছু মানুষ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর দরজায় বসেছিল। তাদের কেউ বলে, আল্লাহ কি একথা বলেননি? আবার কেউ বলে, আল্লাহ কি একথা বলেননি? রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) একথা শুনতে পান। তাঁর পবিত্র মুখমন্ডল ক্রোধে লাল হয়ে যায়, যেন তাঁর মুখমন্ডলে বেদানার রস ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, তোমাদের কি এরূপ করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যে, আল্লাহর কিতাবের এক অংশকে অন্য অংশের বিপরীতে দাঁড় করাবে? তোমাদের পূর্ববর্তী উম্মতগুলি এরূপ করার কারণেই বিভ্রান্ত হয়েছে। তোমাদের কাজ এটি নয়। তোমাদেরকে কি করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে তা দেখ এবং তা পালন কর। আর যা তোমাদের নিষেধ করা হয়েছে তা বর্জন কর’ (আহমদ হা/৬৮৪৫, শুআইব আরনাউত হাদীছটিকে ছহীহ বলেছেন।)
সুতরাং এটাই প্রতিয়মান হয় যে, সত্য ও ন্যায়বিচারের ওপর ভিত্তি করে কুরআনের প্রতিটি নির্দেশ ও বিধিবিধান বর্ণনা করা হয়েছে। এর মানে এই নয় যে, সততা ও ন্যায়পরাণতা দ্বীনের মূল ভিত্তি। দ্বীনের মূল ভিত্তি সম্পর্কে নিচে আলোকপাত করা হলো-
ইসলামের মূলভিত্তি :
ইসলামের মূল স্তম্ভ বা খুঁটি হলো ৫টি। যথা- মুখে স্বীকৃতি, ছালাত আদায় করা, ছিয়াম পালন করা, যাকাত প্রদান করা ও হজ্জ সম্পাদন করা। হাদীসে এসেছে, আব্দুল্লাহ ইবনে ওমার (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, بُنِىَ الإِسْلاَمُ عَلَى خَمْسٍ شَهَادَةِ أَنْ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا رَسُولُ اللهِ ، وَإِقَامِ الصَّلاَةِ ، وَإِيتَاءِ الزَّكَاةِ ، وَالْحَجِّ ، وَصَوْمِ رَمَضَانَ. ‘ইসলামের স্তম্ভ হচ্ছে পাঁচটি। ১. আল্লাহ্ ব্যতীত প্রকৃত কোন উপাস্য নেই এবং নিশ্চয়ই মুহাম্মাদ (ছাঃ) আল্লাহর রাসূল-এ কথার সাক্ষ্য প্রদান করা। ২. ছালাত কায়িম করা। ৩. যাকাত আদায় করা। ৪. হজ্জ সম্পাদন করা এবং ৫. রমাযানের ছিয়াম পালন করা (বুখারী হা/৮; মুসলিম হা/১৬; মিশকাত হা/৪)।
এ হাদীসের ব্যাখ্যা এভাবে দেওয়া হয়, ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভকে এমন দালানের বা তাঁবুর সাথে তুলনা করা হয়েছে যা পাঁচটি স্তম্ভের উপর প্রতিষ্ঠিত। ইসলামের স্তম্ভগুলোর কেন্দ্রবিন্দু হলো শাহাদাহ্ তথা আল্লাহর একত্ববাদ ও তার রসূলের রিসালাতের সাক্ষ্য দেয়া। যেমনটি তাঁবুর পাঁচটি খুঁটির মধ্যে তার মধ্যস্থলের খুঁটিটি অন্যান্য খুঁটির কেন্দ্রবিন্দু। ঈমানের অন্যান্য শাখা প্রশাখা তাঁবুর পেরেকের ন্যায় যা তাকে পূর্ণতা দান করে।
যদি তাঁবুর পেরেকগুলোর কোন একটি নাও থাকে তাহলে তাঁবুর মধ্যে অসম্পূর্ণতা থাকবে যদিও তা দন্ডায়মান থাকবে। তবে পাঁচটি খুঁটির একটিও না থাকে তবে তাঁবু আর দন্ডায়মান থাকবে না। অনুরূপভাবে ইসলামের সবগুলো স্তম্ভ হারিয়ে গেলে ইসলাম থাকবে না। তেমনি আল্লাহর একত্ববাদ ও রসূলের রিসালাতের সাক্ষ্য বাদ দিলে ইসলাম বিদূরীত হয়ে যাবে।
আর ঈমানের শাখা-প্রশাখার অন্যতম মুমিনের ছয়টি বিশ্বাসের ভিত্তি : যথা- أَنْ تُؤْمِنَ بِاللهِ وَمَلاَئِكَتِهِ وَكُتُبِهِ وَرُسُلِهِ وَالْيَوْمِ الآخِرِ وَتُؤْمِنَ بِالْقَدَرِ خَيْرِهِ وَشَرِّهِ. ‘আমি বিশ্বাস স্থাপন করলাম (১) আল্লাহ উপরে (২) তাঁর ফেরেশতাগণের উপরে (৩) তাঁর প্রেরিত কিতাব সমূহের উপরে (৪) তাঁর রাসূলগণের উপরে (৫) ক্বিয়ামত দিবসের উপরে এবং (৬) আল্লাহ্র পক্ষ হ’তে নির্ধারিত তাক্বদীরের ভাল-মন্দের উপরে’ (হাদীছে জিব্রীল, মুসলিম হা/৮; মিশকাত হা/২ ‘ঈমান’ অধ্যায়)।
তবে সালাত পরিত্যাগের ব্যাপারে মতভেদ রয়েছে। কিছুসংখ্যক পূর্ববর্তী ও পরবর্তী বিদ্বানের মতে সালাত পরিত্যাগ করা কুফরী। তারা একাধিক হাদীস দ্বারা এর প্রমাণ পেশ করেছেন যা সালাত পরিত্যাগকারীকে কাফির বলে প্রমাণ করে। মুহাম্মাদ বিন নাসর বলেনঃ অধিকাংশ হাদীস বিশারদের অভিমতও তাই। আর তাদের একদলের মতে, যে ব্যক্তি ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের কোন একটি ইচ্ছাকৃতভাবে পরিত্যাগ করে সে কাফির হয়ে যাবে।
ইমাম নাবাবী বলেনঃ শাহাদাতায়নের মাধ্যমেই বাহ্যিকভাবে কোন লোক ইসলামের গণ্ডীরমধ্যে আছে বলে সাব্যস্ত হয়। এই শাহাদাতায়নের সাথে সালাত ও অন্যান্য স্তম্ভকে তার দিকে নিসবাত করা হয়েছে এজন্য যে, তা ইসলামের সর্বাপেক্ষা বাহ্যিক আলামত। তা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই তার ইসলাম পূর্ণতা লাভ করে। কোন ব্যক্তি তা পরিত্যাগ করলে সে ইসলামের বন্ধন খুলে ফেলেছে বলে অনুভূত হয়। যদি প্রশ্ন করা হয় যে, ভিত্তি ও তার উপর প্রতিষ্ঠিত বস্তু এক নয়। তাহলে এর জবাব হলো সবগুলো স্তম্ভের সমন্বয়েই ইসলাম প্রতিষ্ঠিত। এর কোন একটি বাদে সবগুলো পাওয়া সম্ভব নয়। অথবা বলা যায় যে, ইসলাম অর্থ সাধারণভাবে আত্মসমপর্ণের নাম, বিশেষ কোন আত্মসমর্পণের নাম নয়। যাতে এটা আবশ্যক হয় যে, ভিত্তি ও তার উপর প্রতিষ্ঠিত বস্তু একই। অর্থাৎ- সাধারণ আত্মসমর্পণ সঠিক হওয়া নির্ভর করে ঐ সমস্ত কাজ সম্পাদনের উপর যা করণীয় আবশ্যক।
সততা ও ন্যাপরায়ণতা সম্পর্কে কিছু কথা :
সততা ও ন্যায়পরাণতা মুমিন বান্দাদের গুণাবলীর মধ্যে অন্যতমদ্বয়। এগুলো না থাকলে মুমিনের ঈমানের হ্রাস ঘটে এমনকি ঈমানও চলে যায়। আল্লাহ সৎ নিষ্ঠাবান ইনসাফকারীকে ভালোবাসেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘‘তোমরা ইনসাফ করবে, নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা ইনসাফকারীদের পছন্দ করেন’’ (আল হুজুরাত ৪৯/১৫)।
আবদুল্লাহ ইবনু ’আমর ইবনুল ’আস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ «إِنَّ الْمُقْسِطِينَ عِنْدَ اللَّهِ عَلَى مَنَابِرَ مِنْ نُورٍ عَنْ يَمِينِ الرَّحْمَنِ وَكِلْتَا يَدَيْهِ يمينٌ الذينَ يعدِلُونَ فِي حُكمِهم وأهليهم وَمَا ولُوا» নিশ্চয়ই সত্যনিষ্ঠ বিচারক আল্লাহ তা’আলার নিকট তাঁর ডানপাশে নূরের মিম্বারের উপর অবস্থান করবে। যদিও আল্লাহ তা’আলার উভয় হাতই ডান (কল্যাণকর)। তারা হলো সে সমস্ত বিচারক- যারা তাদের বিচারালয়ে, নিজেদের পরিবার-পরিজনদের মাঝে এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় ন্যায় ও ইনসাফ কায়িম করে। (মুসলিম হা/১৮২৭, নাসায়ী হা/৫৩৭৯, মিশকাত হা/৩৬৯০)।
ইসলামের মৌলিক বিষয় সত্যবাদিতা ও ন্যায়পরায়ণতা নয়। কেননা এগুলো প্রাক-ইসলামে আরব জাহানে সততা, ন্যায়পরায়ণতা, আমানতদারিতা ইত্যাদি গুণ বিদ্যমান ছিল। আর রাসূলুল্লাহ (ছা.) তাওহীদের দাওয়াত দিতে এসেছিলেন। বলা যায়, পোশাক পরিবর্তনের জন্য নয়, বরং তিনি আক্বীদা পরিবর্তনের জন্য প্রেরিত হয়েছিলেন। সুতরাং আক্বীদাহ পরিবর্তন ব্যতীত সত্যবাদিতা ও ন্যায়পরায়ণতার কোন মূল্য নেই। আর বিধর্মীদের মধ্যে এটা অতিব পবিত্র বিষয় হিসেবে তারা পালন করে। প্রশ্ন হলো- তারা কি জান্নাতে যেতে পারবে? উত্তর : না। কেননা তাদের মধ্যে আক্বীদা নেই। ইসলামের মূল ভিত্তি ৫টি। তাওহীদে স্বাক্ষ্য / দৃঢ় বিশ্বাস ( অদৃশ্য বিশ্বাস ছয়টি), ছালাত, ছিয়াম, হজ্জ ও যাকাত।
বিদ‘আতীদের সাথে উঠাবসার নীতিমালা :
সালাফীগণ মনে করেন, বিদআতীদের থেকে জ্ঞান গ্রহণ করা এবং তাদের সাথে উঠা বসাতে অন্তর পরিবর্তনে ও দ্বীনের সঠিক বুঝ গ্রহণে বাঁধা দিতে প্রভাব বিস্তার করে। এদের মজলিশে উঠা বসা করে সালাফীগণ অধিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকেন। যা কঠিন ভাবে নিষেধ রয়েছে।
বিদ‘আতী ব্যক্তি সম্পর্কে রাসূল (ছাঃ) হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করে বলেছেন,
(১) ‘যে ব্যক্তি কোন বিদ‘আতীকে সাহায্য করে, আল্লাহ তাকে লা‘নত করেন’।[মুসলিম হা/১৩৬৬]
(২) ‘যে বিদ‘আতীকে সম্মান করল, সে ইসলাম ধ্বংসে সাহায্য করল’।[মিশকাত হা/১৮৯; তারাজু‘আত হা/৫৯, সনদ হাসান]
(৩) ‘যে বিদ‘আতীকে আশ্রয় দিল, তার প্রতি আল্লাহর অভিশাপ’।[মুসলিম হা/১৯৭৮; মিশকাত হা/৪০৭০]
(৪) ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ প্রত্যেক বিদ‘আতীর থেকে তওবাকে আড়াল করে রাখেন, যতক্ষণ না সে বিদ‘আত পরিহার করে’।[ত্বাবারানী, ছহীহ তারগীব হা/৫৪]
(৫) ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ প্রত্যেক বিদ‘আতীর তওবা প্রত্যাখ্যান করেন’।[ছহীহুল জামে‘ হা/১৬৯৯]
(৬) ‘আল্লাহ প্রত্যেক বিদ‘আতীর আমল প্রত্যাখ্যান করেন, যতক্ষণ না সে বিদ‘আত পরিহার করে’।[সুনান ইবনু মাজাহ হা/৫০; তারাজু‘আত হা/২৫]
বিদ‘আত সম্পর্কে সালাফে ছালেহীনগণের মতামত :
(১) খলীফা আবূ বকর (রাঃ) বলেছেন, ‘সুন্নাতই হ’ল আল্লাহর মযবূত রজ্জু’।
(২) ওমর (রাঃ) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি সুন্নাত ত্যাগ করল, সে কুফরী করল। অন্যত্র তিনি বলেন, ‘যারা নিজ রায়ের ভিত্তিতে কথা বলে, তারা সুন্নাতের শত্রু।…তারা নিজেরা পথভ্রষ্ট হয়েছে এবং অন্যদেরও বিপথগামী করেছে।
(৩) আববাস (রাঃ) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি সুন্নাতের বিরোধিতা করে, সে নিজ প্রবৃত্তির অনুসরণ করে, যদিও তার গলা কাটা যায়’।
(৪) ইবনে আববাস (রাঃ) বলেন, ‘প্রতি বছরই লোকজন একটি বিদ‘আত চালু করছে এবং একটি সুন্নাতকে মেরে ফেলছে। শেষ পর্যন্ত বিদ‘আতই জীবন্ত হবে এবং সুন্নাত মৃত্যু বরণ করবে’।[আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের পরিচিতি, পৃঃ ৪২-৫৫।]
(৫) ইব্রাহিম বিন মাইসারাহ বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোন বিদআতীকে তা’যীম বা শ্রদ্ধা করে সে অবশ্যই ইসলাম ধ্বংসে সহায়তা করে। আল্লাহ তাআলা বলেন, يَوْمَ تَبْيَضُّ وُجُوهٌ وَتَسْوَدُّ وُجُوهٌ ‘ সেদিন কতকগুলো মুখমণ্ডল সাদা (উত্তঞ্জল) হবে এবং কতকগুলো মুখমণ্ডল হবে কালো’। ( আলে ইমরান ১০৬)
(৬) ইবনে আব্বাস (রাঃ) এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, সেদিন যাদের মুখমণ্ডল উজ্জল হবে তাঁরা আহলে সুন্নাহ অল-জামাআহ (হাদীস ও সাহাবার অনুসারীদল) এবং উলামা। আর যাদের মুখমণ্ডল কালো হবে তারা হল, বিদআতী ও ভ্রষ্টের দল। (তফসীর ইবনে কাছীর)
(৭) সুফইয়ান সাওরী (রঃ) বলেন, ‘ইবলীসের নিকট পাপের চেয়ে বিদআতই অধিকতর পছন্দনীয়। কারণ, পাপ হতে তওবার আশা থাকে, কিন্তু বিদআত হতে তওবার কোন সম্ভাবনা থাকে না। (অর্থাৎ, তওবার তওফীকই লাভ হয় না। কারণ, বিদআতী তার বিদআতকে দ্বীন মনে করে থাকে।) ইবনে আবী আসেম প্রভৃতি বর্ণনা করেন যে, নবী ঐ বলেছেন, “শয়তান বলে। আমি মানুষকে বিভিন্ন পাপ দ্বারা সর্বনাশগ্রস্ত করেছি, কিন্তু ওরা আমাকে “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ ও ইস্তিগফার দ্বারা ধ্বংস করেছে। অতঃপর যখন আমি তা লক্ষ্য করলাম, তখন ওদের মধ্যে কুপ্রবৃত্তি প্রক্ষিপ্ত করলাম। সুতরাং ওরা পাপ করবে; কিন্তু আর ইস্তিগফার করবে না। কারণ, তারা ধারণা করবে যে, তারা ভালো কাজই করছে।”
(৮) ইমাম ইবনুল কাইয়েম (রঃ) বলেন, সাধারণ পাপীর ক্ষতি তার নিজের উপরই বর্তায়, কিন্তু বিদআতীদের ক্ষতি ও অনিষ্ট শ্রেণী (বহু মানুষের) উপর ব্যাপক হয়। বিদআতীর ফিৎনা হয় মূল দ্বীনে অথচ সাধারণ পাপীর ফিৎনা তার প্রবৃত্তিতে হয়।। বিদআতী সহজ ও সরল পথের উপর বসে মানুষকে সে পথে চলা হতে বিরত করে, কিন্তু পাপী সেরূপ করে না। বিদআতী আল্লাহর গুণগ্রাম ও তার পরিপূর্ণতায় আঘাত হানে, অথচ পাপী তা করে না। বিদআতী রাসূল (সা.) কর্তৃক আনীত শরীয়তের পরিপন্থী হয়, কিন্তু পাপী তা হয় না। বিদআতী মানুষকে আখেরাতের সঠিক পথ হতে বিচ্যুত করে, কিন্তু পাপী নিজেই স্বীয় পাপের কারণে মৃদুগামী হয়। (আলজাওয়াবুল কাফী)
ঈমান ও কুফর তার নিকট একাকার হয়ে সালাফিয়াত বা সুন্নিয়াত চুরমার হয়ে যাবে। যেহেতু অন্যায়ের সাথে আপোস করে সালাফিয়াত থাকে না। কারণ, হক এক ও অদ্বিতীয়। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন, فَمَاذَا بَعْدَ الْحَقِّ إِلَّا الضَّلَالُ হক ও সত্য ত্যাগ করার পর বিভ্রান্তি ছাড়া আর কি? (সুরা ইউনুস ৩২ আয়াত) আর সে হকের পথ সরল। বাকি ডানে বামে সবই বাঁকা পথ। যাতে ভ্রান্তি ও ভ্রষ্টতা ছাড়া কিছু নেই। যেমন সরল রেখার আয়াত ও হাদীসে পুর্বে আলোচনা করা হয়েছে।
অতএব বলাই বাহুল্য যে, একজন সালাফী বা আহলে সুন্নাহ কোন বিদআতীর দলে একাকার হতে পারে না। (অবশ্য কূটনীতির ক্ষেত্রে ভিন্ন কথা) আহলে সুন্নাহ ও সালাফী একতার ডাক দেয়, ইসলামী রাষ্ট্র রচনা করতে চায় এবং ঐক্য ও মিলনকে ওয়াজেবও মনে করে। তবে ন্যায় ও তাওহীদের উপর কিতাব ও সুন্নাহর উপর এবং জামাআত ও সাহাবাগণের সমঝের উপর। কিতাব ও সুন্নাহর ডাকে জামাআত ও সাহাবাগণের সমঝের আওয়াজ ভিন্ন অন্য কোন ঐক্যের প্রতি সালাফীরা আহবান করে না এবং মিথ্যা আহবানে সাড়া দেয় না। যেহেতু একতা কেবল কিতাব ও সুন্নাহর (শুদ্ধ ও সঠিক জ্ঞানের) প্লাটফর্মে সম্ভব। শির্ক ও বিদআতের ‘জগাখিচুড়ি’ ময়দানে সম্ভব নয়। কেউ যদি সলফ বা আহলে সুন্নাহর রীতি-নীতি অবলম্বন করে এবং শির্ক ও বিদআত বর্জন করে একতা প্রতিষ্ঠার জন্য বাতিলকে স্বীকৃতি দিয়ে। কোন সালাফী আপন (কুরআন ও সহীহ সুন্নাহ তথা সাহাবার) নীতি ও বিশ্বাসের একটি হরফও ছাড়তে বিন্দুমাত্র রাজী নয়।
পক্ষান্তরে ঐ ধরনের আপোস ও ঐক্যের মানুষদেরকে ঐক্যবদ্ধ দেখলেও তাদের। আপোষের আন্তরিক ও মানসিক মিল থাকে না। ফলে ঐ মরিচীকাকে দুর হতে পানি মনে হলেও নিকটে বা বাস্তবে তা নয়। যে অট্টালিকা কাঁচা-পাকা-ভুয়া প্রভৃতি ইষ্টক দ্বারা নির্মিত, তা যে তিষ্ঠিতে পারে না অথবা অদুরেই সদ্যপাতী হয়, তা সকল স্থপতির জ্ঞান অবশ্যই আছে।
(৯) পরিশেষে বলতে হয় বিদআতীরা ডিবেট এর আহ্বান করলেও তাদের সাথে বসা যাবে এটা সালাফীদের একান্ত বুঝ ও নীতিমালা। একদা এক ব্যক্তি এসে হাসান বসরী (রহি.)-কে বললো, ‘হে আবু সাঈদ, আসুন, আপনার সাথে দীনের কিছু মাসআলায় ডিবেট করি। জবাবে হাসান বসরী (রহি.) বলেন, “আমি তো আমার দ্বীন জেনেবুঝে গ্রহণ করেছি, তুমি যদি তোমার দ্বীন হারিয়ে ফেলে থাক, তবে সেটা খুঁজে বেড়াও।”- (আল-আজুররী, আশ শারীআহ, আছার নং ১৯৭৭)।
অতএব দ্বীনের মূল ভিত্তি ও নীতিমালার কোন প্রকার বিকৃতি করা চলবে না। যদি কেউ তা করে, তবে সে স্পষ্ট কুফরী করবে। বিদআতীদের সাথে ঐক্য, সুসম্পর্ক, তাদের মসলিজে উঠা বসা এবং সখ্যতা বজায় রাখেনি বিগত সালাফে সালেহীন ব্যক্তিগণ।
আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে সঠিক দ্বীনের সঠিক বুঝ ও ওপর অবিচল থাকার তাওফীক্ব দান করুন, আমীন।