কুরবানীর গোশত বন্টনের নিয়ম

কুরবানী করা ওয়াজেব নয়; সুন্নাতে মুআক্কাদাহ্। ঠিক অনুরূপ লোক দেখানোর জন্য বেশ কয়েকটি কুরবানী করাও সুন্নাহর পরিপন্থী। যেহেতু হাদীসানুসারে একটি পরিবারের সকলের তরফ হতে কেবল একটি পশুই যথেষ্ট। সাহাবাদের আমলও অনুরূপ ছিল। গৃহপালিত চতুষ্পদ জন্তু’ হল উট, গরু, ছাগল ও ভেড়াকে বুঝানো হয়েছে। এদের উপর আল্লাহর নাম উচ্চারণ করার অর্থ, এদের যবেহ করা, যা আল্লাহর নাম নিয়েই করা হয়। আর ‘বিদিত দিনগুলি’ বলতে যবেহর দিনগুলি; অর্থাৎ তাশরীকের দিনসমূহকে বুঝানো হয়েছে। সুতরাং যবেহর দিন হল, কুরবানীর দিন (১০ম যুলহজ্জ) ও তার পরের তিন দিন (১১, ১২ ও ১৩ই যুলহজ্জ) পর্যন্ত কুরবানী করা যায়।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,  لِّیَشۡهَدُوۡا مَنَافِعَ لَهُمۡ وَ یَذۡكُرُوا اسۡمَ اللّٰهِ فِیۡۤ اَیَّامٍ مَّعۡلُوۡمٰتٍ عَلٰی مَا رَزَقَهُمۡ مِّنۡۢ بَهِیۡمَۃِ الۡاَنۡعَامِ ۚ فَكُلُوۡا مِنۡهَا وَ اَطۡعِمُوا الۡبَآئِسَ الۡفَقِیۡرَ ‘যাতে তারা তাদের জন্য (এখানে রাখা দুনিয়া ও আখিরাতের) কল্যাণগুলো প্রত্যক্ষ করতে পারে আর তিনি তাদেরকে চতুষ্পদ জন্তু হতে যে রিযিক দান করেছেন, নির্দিষ্ট দিনগুলোতে তার উপর আল্লাহর নাম উচ্চারণ করতে পারে। কাজেই তোমরা (নিজেরা) তাত্থেকে খাও আর দুঃস্থ অভাবীদের খাওয়াও।  (হজ্জ 22/২৮)। তিনি আরও বলেন, وَ الۡبُدۡنَ جَعَلۡنٰهَا لَكُمۡ مِّنۡ شَعَآئِرِ اللّٰهِ لَكُمۡ فِیۡهَا خَیۡرٌ فَاذۡكُرُوا اسۡمَ اللّٰهِ عَلَیۡهَا صَوَآفَّ ۚ فَاِذَا وَجَبَتۡ جُنُوۡبُهَا فَكُلُوۡا مِنۡهَا وَ اَطۡعِمُوا الۡقَانِعَ وَ الۡمُعۡتَرَّ ؕ كَذٰلِكَ سَخَّرۡنٰهَا لَكُمۡ لَعَلَّكُمۡ تَشۡكُرُوۡنَ  ‘আর কুরবানীর উটকে আমি তোমাদের জন্য আল্লাহর অন্যতম নিদর্শন বানিয়েছি; তোমাদের জন্য তাতে রয়েছে কল্যাণ। সুতরাং সারিবদ্ধভাবে দন্ডায়মান অবস্থায় সেগুলির উপর আল্লাহর নাম উচ্চারণ কর যখন সেগুলি কাত হয়ে পড়ে যায় তখন তা থেকে খাও। যে অভাবী, মানুষের কাছে হাত পাতে না এবং যে অভাবী চেয়ে বেড়ায়-তাদেরকে খেতে দাও। এভাবেই আমি ওগুলিকে তোমাদের অনুগত করে দিয়েছি; যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর।  (হজ্জ 22/৩৬)

প্রচলিত তিনভাগে গোশত বণ্টন করার উদ্দেশ্য হল ১ম ভাগ নিজের জন্য, ২য় ভাগ প্রতিবেশী ও আত্মীয়-স্বজনদের জন্য এবং ৩য় ভাগ ফকীর মিসকিনদের জন্য। এটি একটি সুন্দর নিয়ম যা সাহাবাগণও করেছেন। ইবনু মাসঊদ (রাঃ) কুরবানীর গোশত তিনভাগ করে একভাগ নিজেরা খেতেন, একভাগ যাকে চাইতেন তাকে খাওয়াতেন এবং একভাগ ফকীর-মিসকীনকে দিতেন। আবদুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) রাসূল (ছাঃ)-এর কুরবানীর গোশত বন্টন সম্পর্কে বলেন যে, তিনি একভাগ নিজের পরিবারকে খাওয়াতেন, একভাগ গরীব প্রতিবেশীদের দিতেন এবং একভাগ সায়েল-ফকীরদের দিতেন। হাফেয আবু মূসা বলেন, হাদীছটি ‘হাসান’। তবে আলবানী বলেন, আমি এটির সনদ জানতে পারিনি। জানি না তিনি অর্থের দিক দিয়ে ‘হাসান’ বলেছেন, না সনদের দিক দিয়ে (ইরওয়া হা/১১৬০; আলোচনা দ্রষ্টব্য: মির‘আত হা/১৪৯৩-এর ব্যাখ্যা, ৫/১২০ পৃঃ)। এছাড়া ইমাম আহমাদ, শাফেঈ (রহঃ) সহ বহু বিদ্বান কুরবানীর গোশত তিনভাগ করাকে মুস্তাহাব বলেছেন (সুবুলুস সালাম শরহ বুলূগুল মারাম ৪/১৮৮ পৃঃ)

সালামাহ্ ইবনুল আক্ওয়া (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তোমাদের মাঝে যে ব্যক্তি কুরবানী করে, তৃতীয় দিনের পর সকালেও যেন তার ঘরে কুরবানীর মাংসের কিয়দংশও অবশিষ্ট না থাকে। রাবী (সালামাহ্) বলেন, পরবর্তী বছর আসলে সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রসূল! আমরা গত বছর যা করেছি এ বছরও কি সেভাবে করবো? তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, না; তোমরা খাও, অন্যদরকেও খাওয়াও এবং (যদি ইচ্ছা কর তবে) জমা করে রেখো। কারণ গত বছর তো মানুষ অভাব-অনটনের মধ্যে ছিল। আর তাই আমি চেয়েছিলাম, তোমরা তাদের সাহায্য করো। (বুখারী হা/৫৫৬৯, মুসলিম হা/১৯৪৭, ইরওয়া হা/১১৫৬, মিশকাত হা/২৬৪৪)।

নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানুষদের তিন দিনের বেশি কুরবানীর গোশ্‌ত জমা করে রাখতে নিষেধ করেছেন, কারণ সে বছর দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়ায় মদীনার আশেপাশের গ্রাম্য লোকেরা মদীনায় এসে আশ্রয় নিলে তিনি তাদেরকে সহযোগিতার উদ্দেশে এ আদেশ দিলেন। পরবর্তী বছর মানুষেরা এ বিষয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলে তিনি উত্তরে বললেন, সে হুকুম দুর্ভিক্ষের কারণে ছিল বরং তোমরা নিজেরা খাও, অপরকে খাওয়াও এবং পরবর্তীর জন্য জমা করে রাখ।

হাফিয ইবনু হাজার আসকালানী (রহঃ) বলেন, যারা বলেন যে কুরবানীর গোশ্‌ত থেকে খাওয়া আবশ্যক তারা এটিকে নিজেদের দলীল হিসেবে গ্রহণ করেছে। তবে এতে তাদের পক্ষের দলীল নেই। কারণ যখন আমরের সীগাহ্ হাযর বা নিষেধসূচক বাক্যের পরে আসবে তখন তা মুবাহের অর্থ দিবে। ইমাম নাবাবী (রহঃ) বলেন, কুরবানীর গোশত থেকে খাওয়া মুস্তাহাব। আর জমহূর ‘আলিমগণ এ ‘আমলটিকে মানদূব বা মুবাহের অর্থে গ্রহণ করেছেন।

খাত্ত্বাবী (রহঃ) বলেন, মুত্বলাক্ব হাদীসসমূহ প্রমাণ করে যে, কুরবানীর গোশত খাওয়ার পরিমাণের ক্ষেত্রে কোন সীমাবদ্ধতা নেই। আর কুরবানী দাতার জন্য কুরবানীর গোশতের কিছু অংশ খাওয়া আর বাকীটুকু সাদাকা এবং হাদিয়্যাহ্ করা মুস্তাহাব।

ইমাম শাফি‘ঈর বর্ণনা হলো কুরবানীর গোশতকে তিন ভাগে বিভক্ত করা মুস্তাহাব। যেহেতু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমরা নিজেরা খাও, অপরকে খাওয়াও আর সাদাকা কর। ইবনু ‘আবদুল বার (রহঃ) বলেছেন, ইমাম শাফি‘ঈ ছাড়া অন্যরা বলতেন অর্ধেক নিজে খাওয়া আর বাকী অর্ধেক অপরকে খাওয়ানো মুস্তাহাব। ইমাম নাবাবী (রহঃ) বলেন, জমহূরের মত হলো কুরবানীর গোশত থেকে খাওয়া আবশ্যক নয়। এ ক্ষেত্রে আদেশটি অনুমতির জন্য। আর তার থেকে সাদাকা করার বিষয়ে সঠিক বক্তব্য হলো যতটুকু করলে সাদাকা বুঝাবে ততটুকু করা আবশ্যক। তবে বেশি অংশ সাদাকা করাই উত্তম। ইবনু হাযম (রহঃ) তার ‘মুহাল্লা’ নামক গ্রন্থে বলেন, প্রত্যেক কুরবানীদাতার ওপর আবশ্যক হলো, সে তার কুরবানীর গোশত হতে এক লোকমা হলেও খাবে এবং কম হোক বা বেশি হোক সাদাকা করবে। তবে তার থেকে ধনী, কাফিরদের খাওয়ানো এবং উপঢৌকন দেয়া মুবাহ।

ইবনু কুদামাহ্ (রহঃ) তাঁর ‘‘আল মুগনী’’ নামক গ্রন্থে বলেন, ইমাম আহমাদ (রহঃ) বলেছেন, আমরা ‘আব্দুল্লাহ বিন মাস্‘ঊদ (রাঃ)-এর হাদীসকে গ্রহণ করব। যেখানে বর্ণিত আছে কুরবানীদাতা এক তৃতীয়াংশ খাবে। এক তৃতীয়াংশ যাকে খুশি খাওয়াবে, আর এক তৃতীয়াংশ মিসকীনদের সাদাকা করবে। ‘আলক্বমাহ্ (রহঃ) বলেন, ‘আব্দুল্লাহ বিন মাস্‘ঊদ (রাঃ) আমাকে একটি হাদীয়াহ দিয়ে প্রেরণ করে বললেন, যেন আমি এক তৃতীয়াংশ খাই, এক তৃতীয়াংশ তার ভাই ‘উতবাহ্’র পরিবারে প্রেরণ করি আর বাকী এক-তৃতীয়াংশ সাদাকা করি। ইবনু ‘উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ কুরবানী এবং হাদীর গোশতের এক তৃতীয়াংশ তোমার, এক তৃতীয়াংশ তোমার পরিবারের আর এক তৃতীয়াংশ মিসকীনদের। আদ্ দুররুল মুখতারের লেখক বলেন, কুরবানীর গোশত থেকে খাবে, ধনীদের খাওয়াবে এবং জমা করে রাখবে তবে সাদাকা এক-তৃতীয়াংশের কম না হওয়ায় ভাল।(আস-সুনানুল কুবরা লিল বাইহাকী হা/১০২৩৮)

অতএব কুরবানীর গোশত তিন ভাগ করা যায়। একভাগ নিজেদের ও একভাগ প্রতিবেশীদের যারা কুরবানী করেনি এবং এক ভাগ ফকীর-মিসকীনদের। প্রয়োজনে বণ্টনে কমবেশী করাতে কোন দোষ নেই (সুবুলুস সালাম শরহ বুলূগুল মারাম ৪/১৮৮; আল-মুগনী ১১/১০৮; মির‘আত ২/৩৬৯; ঐ, ৫/১২০ পৃঃ)। উল্লেখ্য যে, কুরবানীর গোশত যতদিন খুশী রেখে খাওয়া যায় (তিরমিযী হা/১৫১০, মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/২৭৪৪)

আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল ‘আছ (রাঃ) তাঁর ইহূদী প্রতিবেশীকে দিয়েই গোশত বণ্টন শুরু করেছিলেন (বুখারী, তিরমিযী হা/১৯৪৩; আল-আদাবুল মুফরাদ হা/১২৮, সনদ ছহীহ, ‘ইহূদী প্রতিবেশী’ অনুচ্ছেদ)। ‘তোমরা মুসলমানদের কুরবানী থেকে মুশরিকদের আহার করাবে না’ মর্মে যে হাদীছ এসেছে তা ‘যঈফ’ (বায়হাক্বী, শু‘আবুল ঈমান হা/৯১১৩)

সুতরাং অবশ্যই আমাদের চারপাশের অভাবী, দুস্থ, গরীব, দুঃখী মানুষগুলোর প্রতি আলাদা নযর রাখবেন। যদি আপনার প্রতিবেশী কাফের মুশরেক হয় তবুও তাদেরকে এ আনন্দ থেকে বঞ্চিত রাখবেন না। তাদেরকেও কুরবানীর গোশত প্রদানে তারা আপনাদের দ্বীনের প্রতি আকৃষ্ট হতে পারেন এবং মুসলমানদের রীতিনীতির উপর রাজি খুশি হতে পারেন। আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীর হক্বের প্রতি সদা যত্নশীল হোন।

মনে রাখবেন, আপনি যা খাবেন আর যা সাদাকা করবেন তা-ই আপনার পরোকালিন জীবনের জন্য পাথেয়। বেশী বেশী সাদাকা করুন, অভাবী দুস্থদের আপনার খুশিতে শরীক করুন! আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকে দ্বীনে সঠিক বুঝ দান করুন, আমীন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

loader-image

Scroll to Top