নিরপেক্ষভাবে হাদীছ অনুসরণের কারণে ইমাম বুখারী (১৯৪-২৫৬ হিঃ), ইমাম মুসলিম (২০৪-২৬১ হিঃ), ইমাম নাসাঈ (২১৫-৩০৩ হিঃ), ইমাম আবু দাঊদ (২০২-২৭৫ হিঃ), ইমাম তিরমিযী (২০৯-২৭৯ হিঃ), ইমাম ইবনু মাজাহ (২০৯-২৭৩ হিঃ), ইমাম আলী ইবনুল মাদীনী (১৬১-২৩৪ হিঃ), ইমাম ইসহাক্ব ইবনে রাহ্ওয়াইহ (১৬৬-২৩৮ হিঃ), ইমাম আবুবকর ইবনু আবী শায়বা (মৃঃ ২৩৫ হিঃ), ইমাম দারেমী (১৮১-২৫৫ হিঃ), ইমাম আবু যুর‘আ রাযী (মৃঃ ২৬৪ হিঃ), ইমাম ইবনু খুযায়মা (২২৩-৩১১ হিঃ), ইমাম দারাকুতনী (৩০৫-৩৮৫ হিঃ), ইমাম হাকেম (৩২১-৪০৫ হিঃ), ইমাম বায়হাক্বী (৩৮৪-৪৫৮ হিঃ), ইমাম মুহিউস সুন্নাহ বাগাভী (৪৩৬-৫১৬ হিঃ) প্রমুখ হাদীছ শাস্ত্রের জগদ্বিখ্যাত ইমাম ও মুহাদ্দেছীনে কেরাম এবং তাঁদের শিষ্যবর্গ ও অনুসারীবৃন্দ সকলেই ‘আহলুল হাদীছ’ ছিলেন।
আহলেহাদীছের পরিচয় (تَعَارُفُ أَهْلِ الْحَدِيْثِ)
ফারসী সম্বন্ধ পদে ‘আহলেহাদীছ’ এবং আরবী সম্বন্ধ পদে ‘আহলুল হাদীছ’-এর আভিধানিক অর্থ : হাদীছের অনুসারী। পারিভাষিক অর্থ : পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের নিরপেক্ষ অনুসারী। যিনি জীবনের সর্বক্ষেত্রে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের সিদ্ধান্তকে নিঃশর্তভাবে মেনে নিবেন এবং রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লা-হু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও ছাহাবায়ে কেরামের তরীক্বা অনুযায়ী নিজের সার্বিক জীবন গড়ে তুলতে সচেষ্ট হবেন, কেবলমাত্র তিনিই এ নামে অভিহিত হবেন।
ছাহাবায়ে কেরাম হ’লেন জামা‘আতে আহলেহাদীছের প্রথম সারির সম্মানিত দল, যাঁরা এ নামে অভিহিত হ’তেন। যেমন- (১) প্রখ্যাত ছাহাবী আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) (মৃঃ ৭৪হিঃ) কোন মুসলিম যুবককে দেখলে খুশী হয়ে বলতেন,
عَنْ أَبِي سَعِيدٍ الْخُدْرِيِّ أَنَّهُ كَانَ إِذَا رَأَى الشَّبَابَ قَالَ: مَرْحَبًا بِوَصِيَّةِ رَسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَمَرَنَا رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَنْ نُوَسِّعَ لَكُمْ فِي الْمَجْلِسِ وَأَنْ نُفَهِّمَكُمُ الْحَدِيثَ فَإِنَّكُمْ خُلُوْفُنَا وَأَهْلُ الْحَدِيْثِ بَعْدَنَا-
‘রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লা-হু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর অছিয়ত অনুযায়ী আমি তোমাকে ‘মারহাবা’ জানাচ্ছি। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লা-হু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাদেরকে তোমাদের জন্য মজলিস প্রশস্ত করার ও তোমাদেরকে হাদীছ বুঝাবার নির্দেশ দিয়ে গেছেন। কেননা তোমরাই আমাদের পরবর্তী বংশধর ও পরবর্তী ‘আহলেহাদীছ’।[1]
(১) খ্যাতনামা তাবেঈ ইমাম শা‘বী (২২-১০৪হিঃ) ছাহাবায়ে কেরামের জামা‘আতকে ‘আহলুল হাদীছ’ বলতেন। যেমন একদা তিনি বলেন,
لَوِ اسْتَقْبَلْتُ مِنْ أَمْرِيْ مَا اسْتَدْبَرْتُ مَا حَدَّثْتُ إِلاَّ مَا أَجْمَعَ عَلَيْهِ أَهْلُ الْحَدِيْثِ-
‘এখন যেসব ঘটছে, তা আগে জানলে আমি কোন হাদীছ বর্ণনা করতাম না, কেবল ঐ হাদীছ ব্যতীত, যার উপরে ‘আহলুল হাদীছ’ অর্থাৎ ছাহাবায়ে কেরাম একমত হয়েছেন’।[2]
(৩) ছাহাবায়ে কেরামের শিষ্যমন্ডলী তাবেঈন ও তাবে-তাবেঈন সকলে ‘আহলেহাদীছ’ ছিলেন। ইবনু নাদীম (মৃঃ ৩৭০ হিঃ) তাঁর ‘কিতাবুল ফিহরিস্ত’ গ্রন্থে, ইমাম খত্বীব বাগদাদী (৩৯২-৪৬৩ হিঃ) স্বীয় ‘তারীখু বাগদাদ’ দ্বাদশ ও চতুর্দশ খন্ডে এবং ইমাম হেবাতুল্লাহ লালকাঈ (মৃঃ ৪১৮ হিঃ) স্বীয় ‘শারহু উছূলি ই‘তিক্বাদ …’ গ্রন্থে ছাহাবায়ে কেরাম হ’তে শুরু করে তাঁর যুগ পর্যন্ত তৎকালীন মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের আহলেহাদীছ ওলামায়ে কেরাম ও নেতৃবৃন্দের নামের বিরাট তালিকা দিয়েছেন। এতদ্ব্যতীত ‘আহলেহাদীছ-এর মর্যাদা’ শীর্ষক ‘শারফু আছহাবিল হাদীছ’ নামে ইমাম খত্বীব বাগদাদীর একটি পৃথক বইও রয়েছে।
(৪) ইমাম আবু হানীফা (৮০-১৫০ হিঃ), ইমাম মালেক (৯৩-১৭৯ হিঃ), ইমাম শাফেঈ (১৫০-২০৪ হিঃ), ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (১৬৪-২৪১ হিঃ) সকলেই ‘আহলেহাদীছ’ ছিলেন। স্বীয় যুগে হাদীছ তেমন সংগৃহীত না হওয়ার ফলে ইমাম আবু হানীফা (রহঃ) অধিকহারে রায় ও ক্বিয়াসের আশ্রয় নিয়েছিলেন বলে তাঁকে إِمَامُ أَهْلِ الرَّأْىِ বা ‘আহলুর রায়দের ইমাম’ বলা হয়ে থাকে। তিনি নিজে কোন কেতাব লিখে যাননি। বরং শিষ্যদের অছিয়ত করে গিয়েছেন এই বলে যে, إِذَا صَحَّ الْحَدِيْثُ فَهُوَ مَذْهَبِيْ‘ইযা ছাহ্হাল হাদীছু ফাহুয়া মাযহাবী’ অর্থাৎ ‘যখন ছহীহ হাদীছ পাবে, জেনো সেটাই আমার মাযহাব’।[3]
(৫) একবার তিনি তাঁর প্রধান শিষ্য আবু ইউসুফ (১১৩-১৮২ হিঃ)-কে বলেন, لاَ تَرْوِ عَنِّي شَيْئًا فَإِنِّىْ وَاللهِ مَا أَدْرِىْ مُخْطِئٌ أَنَا أَمْ مُصِيْبٌ؟ ‘তুমি আমার পক্ষ হ’তে কোন মাসআলা বর্ণনা কর না। আল্লাহর ক্বসম! আমি জানি না নিজ সিদ্ধান্তে আমি বেঠিক না সঠিক’।[4]
(৬) আরেকবার তিনি তাকে তাঁর বক্তব্য লিখতে দেখে ধমক দিয়ে বলেন,
وَيْكَ يَا يَعْقُوْبُ ! لاَ تَكْتُبْ كُلَّ مَا تَسْمَعُهُ مِنِّى فَإِنِّي قَدْ أَرَى الرَّأْيَ الْيَوْمَفَأَتْرُكُهُ غَدًا، وَ أَرَى الرَّأْىَ غَدًا وَ أَتْرُكُهُ بَعْدَ غَدٍ-
‘সাবধান হে ইয়াকূব (আবু ইউসুফ)! আমার নিকট থেকে যা-ই শোন, তাই-ই লিখে নিয়ো না। কেননা আমি আজকে যে রায় দেই, কালকে তা পরিত্যাগ করি; কাল যে রায় দেই, পরদিন তা প্রত্যাহার করি’।[5]
চার ইমামের সকলেই তাঁদের তাক্বলীদ তথা দ্বীনী বিষয়ে অন্ধ অনুসরণ বর্জন করে ছহীহ হাদীছ অনুযায়ী আমল করার জন্য সকলকে নির্দেশ দিয়ে গেছেন।[6] এ জন্য তাঁরা সবাই নিঃসন্দেহে ‘আহলেহাদীছ’ ছিলেন। কিন্তু তাঁদের অনুসারী মুক্বাল্লিদগণ ইমামদের নির্দেশ উপেক্ষা করে পরবর্তীতে ছহীহ হাদীছ পাওয়া সত্ত্বেও বিভিন্ন অজুহাতে তা এড়িয়ে গিয়ে স্ব স্ব মাযহাবী বিদ্বানদের রায় ও তাঁদের রচিত ফিক্বহ ও ফৎওয়াসমূহের অন্ধ অনুসারী হয়ে প্রকৃত প্রস্তাবে এক ইমামের নামে অসংখ্য আলেমের রায়পন্থী ‘আহলুর রায়’ বনে গেছেন। এ জন্য অনুসারীগণ দায়ী হ’লেও ইমামগণ দায়ী নন। সেকারণ খ্যাতনামা হানাফী বিদ্বান আবদুল ওয়াহ্হাব শা‘রানী (৮৯৮-৯৭৩ হিঃ) বলেন, فَالْإِمَامُ مَعْذُوْرٌ وَ أَتْبَاعُهُ غَيْرُ مَعْذُورِيْنَ ‘ইমামের ওযর আছে, কিন্তু অনুসারীদের জন্য কোন ওযর নেই’।[7]
ইমামদের ওযর আছে এজন্য যে, তাঁরা যে অনেক হাদীছ জানতেন না, সেকথা খোলাখুলিভাবে স্বীকার করে গেছেন ও পরবর্তীতে ছহীহ হাদীছ পেলে তা অনুসরণের জন্য সবাইকে তাকীদ দিয়ে বলে গিয়েছেন। কিন্তু অনুসারীদের কোন ওযর নেই এ কারণে যে, তারা ছহীহ হাদীছ পাওয়া সত্ত্বেও তা গ্রহণ করেনি ও তার উপরে আমল করেনি। বরং তাদের মধ্যে এই অন্ধ বিশ্বাস দানা বেঁধে আছে যে, তাদের অনুসরণীয় ইমাম বা পীর সবকিছু জানেন। তাঁর ভুল হবার সম্ভাবনা নেই। এমনকি তাঁর ভুল হ’তে পারে, এমনটি চিন্তা করাও বে-আদবী। সেকারণ তাঁরা যেকোনভাবেই হৌক, ইমামের রায় বা মাযহাবী ফৎওয়াকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করেন। এমনকি এজন্য ছহীহ হাদীছকে বাদ দিতে হ’লেও কুছ পরওয়া নেই।
অথচ ইমাম গাযালী (৪৫০-৫০৫ হিঃ) স্বীয় ‘কিতাবুল মানখূলে’ বলেন যে, أَنَّهُمَا خَالَفَا أَبَا حَنِيْفَةَ فِىْ ثُلُثَىْ مَذْهَبِهِ ‘ইমাম আবু ইউসুফ ও ইমাম মুহাম্মাদ (রহঃ) তাঁদের উস্তাদ ইমাম আবু হানীফা (রহঃ)-এর মাযহাবের দুই-তৃতীয়াংশের বিরোধিতা করেছেন’।[8] এতদ্ব্যতীত চার ইমামের নামে প্রচলিত ফৎওয়াসমূহ ও বিশেষ করে হানাফী ফিক্বহে বর্ণিত ক্বিয়াসী ফৎওয়াসমূহের সবটুকু অথবা অধিকাংশ ফৎওয়াই ইমাম আবু হানীফা (রহঃ)-এর নয় বলে শাহ অলিউল্লাহ দেহলভী সহ বহু বিদ্বান মন্তব্য করেছেন।[9] শুধু ফিক্বহী বা ব্যবহারিক বিষয়েই নয় বরং উছূলে ফিক্বহ বা ব্যবহারিক আইন সূত্রসমূহেও উক্ত শিষ্যদ্বয় ইমাম আবু হানীফা (রহঃ)-এর বিরোধিতা করেছেন।[10] অতএব ইমাম আবু হানীফা (রহঃ) এবং অন্যান্য ইমামদের যেসব মাযহাব বর্তমানে চালু আছে, তার অধিকাংশ পরবর্তী যুগে দলীয় আলেমদের সৃষ্টি।
[1]. আবুবকর আল-খত্বীব বাগদাদী, শারফু আছহাবিল হাদীছ (লাহোর : রিপন প্রেস, তারিখ বিহীন), পৃঃ ১২; হাকেম একে ছহীহ বলেছেন এবং যাহাবী তাকে সমর্থন করেছেন। -আল-মুস্তাদরাক ১/৮৮ পৃঃ; আলবানী, সিলসিলা ছহীহা হা/২৮০।
[2]. শামসুদ্দীন যাহাবী, তাযকেরাতুল হুফফায (বৈরুত : দারুল কুতুবিল ইলমিয়াহ, তাবি) ১/৮৩ পৃঃ।
[3]. ইবনু আবেদীন, শামী হাশিয়া রাদ্দুল মুহতার (বৈরুত : দারুল ফিক্র ১৩৯৯/১৯৭৯) ১/৬৭ পৃঃ; আব্দুল ওয়াহহাব শা‘রানী, মীযানুল কুবরা (দিল্লী : ১২৮৬ হিঃ) ১/৩০ পৃঃ।
[4]. আবুবকর আল-খত্বীব বাগদাদী, তারীখু বাগদাদ ১৩/৪০২ পৃঃ।
[5]. প্রাগুক্ত; থিসিস পৃঃ ১৭৯, টীকা ৪৮।
[6]. আব্দুল ওয়াহহাব শা‘রানী, মীযানুল কুবরা (দিল্লী: ১২৮৬ হিঃ) ১/৬০।
[7]. প্রাগুক্ত ১/৭৩ পৃঃ।
[8]. শারহু বেকায়াহ-এর মুক্বাদ্দামাহ (দিল্লী ছাপা ১৩২৭) পৃঃ ২৮, শেষ লাইন; ঐ, দেউবন্দ ছাপা, তাবি, পৃঃ ৮।
[9]. শাহ অলিউল্লাহ, ‘হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ’ (কায়রো: ১৩৫৫ হিঃ) ১/১৬০; ছালেহ ফুল্লানী, ঈক্বাযু হিমাম পৃঃ ৯৯; ‘তালবীহ’-এর বরাতে মোল্লা মুঈন সিন্ধী, দিরাসাতুল লাবীব (লাহোর: ১২৮৪ হিঃ) পৃঃ ১৮৩, ২৯০, ২৯১; আব্দুল হাই লাক্ষ্মৌবী, নাফে’ কাবীর পৃঃ ১৩ প্রভৃতি; দ্রঃ থিসিস পৃঃ ১৮০, টীকা ৫৯, ৬০।
[10]. (فَإِنَّهُمَا يُخَالِفَانِ أُصُوْلَ صَاحِبِهِمَا ) সুবকী, ‘ত্বাবাক্বাতুশ শাফেঈয়াহ কুবরা’ (বৈরুত: দারুল মা‘রিফাহ, তাবি) ১/২৪৩ পৃঃ।