দরিদ্রতার সংজ্ঞা নির্ধারণ করতে গিয়ে সমাজতত্ববিদ গোডার্ড বলেছেন , দারিদ্রতা হল ব্যক্তির সেই অবস্থা – যার ফলে ব্যক্তি নিজের ও নিজের উপর নির্ভরশীল ব্যক্তিদের ন্যূনতম চাহিদা পূরণ করতে ব্যর্থ হয় অর্থনৈতিক অবস্থার কারণে।
দরিদ্রতা বিষয়টি আপেক্ষিক। অর্থাৎ এটি কোনো নির্দিষ্ট সমাজের ব্যক্তিবর্গের জীবনযাত্রার উপর নির্ভরশীল। কেননা , সকল সমাজে জীবন যাত্রার মান একই ধরণের হয়না। ধরা যাক A নামক ব্যক্তি B নামক ব্যক্তির তুলনায় বেশি রোজগার করেন। সেক্ষেত্রে B ব্যক্তি A ব্যক্তির তুলনায় দরিদ্র। আবার C ব্যক্তি B ব্যক্তির তুলনায় কম রোজগার করেন। সেক্ষেত্রে C ব্যক্তি B ব্যক্তির তুলনায় দরিদ্র।
অধিকাংশ গরীব ও মিসকিন মানুষ জান্নাতি। রাসূল (ছাঃ) গরীব ও অসহায় মিসকিনদের সাথে হাশর নাশর করার জন্য দোআ করতেন। দুনিয়ার দারিদ্রতা আপনার জন্য কিয়ামতের দিনে কল্যাণ। শর্ত আপনাকে প্রকৃত মুমিন হতে হবে। মুমিনের জীবনে অভাব থাকবে কিন্ত চাহিদা থাকবে না। আবার অল্পে তুষ্ট থাকবে, কিন্তু হতাশাগ্রস্থ হবে না।
রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘আমি জান্নাতের দরজায় দাঁড়ালাম। দেখলাম, যারা জান্নাতে প্রবেশ করছে তাদের অধিকাংশই গরীব-মিসকীন। আর ধনীদেরকে (হিসাবের জন্য) আটকে রাখা হয়েছে … (মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৫২৩৩)। অন্যত্র তিনি বলেন, আমি জান্নাতে উঁকি মেরে দেখলাম যে, এর অধিকাংশ অধিবাসী হ’ল গরীব-মিসকীন … (মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৫২৩৪)।
জান্নাত ও জাহান্নাম এক সময় তাদের অধিক অধিবাসী গ্রহণের ইচ্ছায় বিবাদে লিপ্ত হবে। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘জান্নাত ও জাহান্নামের মধ্যে বিবাদ হ’ল। জাহান্নাম বলল, আমার মধ্যে উদ্ধত অহংকারী লোকেরা থাকবে। আর জান্নাত বলল, আমার মধ্যে দুর্বল ও দরিদ্র ব্যক্তিরা থাকবে। অতঃপর আল্লাহ উভয়ের মধ্যে ফায়ছালা করলেন এইভাবে যে, তুমি জান্নাত আমার রহমত, তোমার দ্বারা আমি যার প্রতি ইচ্ছা অনুগ্রহ করব। আর তুমি জাহান্নাম আমার শাস্তি, তোমার দ্বারা আমি যাকে ইচ্ছা শাস্তি দিব। তোমাদের উভয়কেই পরিপূর্ণ করা আমার দায়িত্ব’ (আহমাদ হা/১১৭৫৪; আল-আদাবুল মুফরাদ হা/৬১৫, সনদ ছহীহ)।
দরিদ্রতা নিয়ে হায় হুতাশ করবেন না। কেননা এটা সাময়িক। সম্পদ আমাদের সমাজে আবর্তিত হয়। সুতরাং দরিদ্রতার কারণে সর্বদা হালাল ছেড়ে হারাম উপার্জনে ব্রত হবেন না। মনে রাখবেন, আল্লাহ পবিত্র আল্লাহ পরিচ্ছন হালাল রুযী পছন্দ করেন। হারাম ভক্ষণকারীর কোন দো‘আ ইবাদত কবূল হয় না, যদিও সে মুসাফির হয়। দ্বীনের গবেষণা করলে এটা প্রতিয়মাণ হয় যে, طلب كسب الحلال فريضة بعد الفريضة ‘অন্যান্য ফরয কাজ আদায়ের সাথে হালাল রুযী-রোজগারের ব্যবস্থা গ্রহণ করাও একটি ফরয’।
অর্থাৎ নিজের প্রয়োজন মিটানো অথবা অন্যের প্রয়োজন মিটানোর দায়িত্ব যার ওপর অর্পিত তার কর্তব্য হলো হালাল উপায়ে উপার্জন করা। রাস্তা খোঁজে বের করা। অর্থাৎ সুনিশ্চিত হালাল এমন পন্থায় উপার্জন করা যা হালাল হতে পারে, আবার হারাম হওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে। এমন সন্দেহজনক পন্থা পরিহার করে নিশ্চিত হালাল পন্থায় উপার্জন করা ফরয।
(بَعْدَ الْفَرِيضَةِ) ‘‘ফরযের পর ফরয’’। অর্থাৎ ছালাত, ছিয়াম ও হজ্জ ইত্যাদি ফরয কার্য সম্পাদনের মতো হালাল উপায়ে উপার্জন করাও একটি ফরয কাজ, আর তা অব্যাহতভাবে চলতে থাকবে। হজ্জ জীবনে মাত্র একবার ফরয, ছিয়াম বৎসরে মাত্র এক মাস, কিন্তু হালাল উপার্জন সর্বদাই ফরয। তা কোনো সময়ের সাথে সীমাবদ্ধ নয়। (মিরকাতুল মাফাতীহ)।
আব্দুল্লাহ ইবনে মুগাফফাল (রাঃ) বলেন, এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে এসে বলল, ’আল্লাহর কসম! আমি অবশ্য অবশ্যই আপনাকে ভালোবাসি।’ তখন তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, ’’তুমি কী বলছ, তা ভেবে দেখ। সে বলল, ’আল্লাহর কসম! আমি অবশ্য অবশ্যই আপনাকে ভালোবাসি।’ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবারও বললেন, ’’তুমি কী বলছ, তা ভেবে দেখ। সে পুনরায় বলল, ’আল্লাহর কসম! আমি অবশ্য অবশ্যই আপনাকে ভালোবাসি।’ একই কথার তিনবার পুনরাবৃত্তি করলে তিনি বললেন, إِنْ كُنْتَ تُحِبُّنِي فَأَعِدَّ لِلْفَقْرِ تِجْفَافًا فَإِنَّ الْفَقْرَ أَسْرَعُ إِلَى مَنْ يُحِبُّنِي مِنَ السَّيْلِ إِلَى مُنْتَهَاهُ যদি তুমি আমাকে ভালোবেসেই থাকো, তাহলে দারিদ্রের জন্য বর্ম প্রস্তুত রাখো। কেননা, যে আমাকে ভালবাসবে, স্রোত তার শেষ প্রান্তের দিকে যাওয়ার চাইতেও বেশি দ্রুতগতিতে দারিদ্র্য তার নিকট আগমন করবে। (তিরমিযী হা/২৩৫০, সিলসিলা ছহীহাহ হা/২৮২৭)।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, বাহ্যিক ঐশ্বর্যে যে ধনী মূলতঃ সে ধনী নয়। কেবল মনের ধনীই বড় ধনী। আল্লাহ যখন তাঁর কোন বান্দার কল্যাণ চান, তখন তিনি তার অন্তর অভাবমুক্ত করে দেন এবং তার হৃদয়ে আল্লাহভীতি দান করেন। আর যখন আল্লাহ কোন বান্দার অকল্যাণ চান, তখন তিনি তার দু’চোখের মাঝে দারিদ্রতা স্থাপন করেন’। (ছহীহ ইবনু হিববান হা/৬২১৭, সিলসিলা ছহীহাহ হা/৩৩৫০)।
হালাল জীবিকা আত্মিক ও মানসিক প্রশান্তির অন্যতম উপায়। পক্ষান্তরে হারাম উপার্জনে মানবজাতির ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত প্রশান্তি দূরীভূত হয়। আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে হতাশাগ্রস্থ না করে প্রশান্তি দান করুন আমীন।