বিজ্ঞান অর্থ বিশেষ জ্ঞান। আমাদের চারপাশে দৃশ্যমান মানব, জীবজগত ও বিভিন্ন বস্ত্ত মানুষের মনে কৌতুহল সৃষ্টি করে এবং এসবের সৃষ্টি রহস্য সম্পর্কে সন্তোষজনক সমাধান খুঁজে ফিরে। এই বিশাল বিশ্বজগত কেমন করে চলছে সেই সত্য উদঘাটনই বিজ্ঞানের উদ্দেশ্য। কিন্তু বাহ্যিকভাবে পঞ্চেন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞানকেই বিজ্ঞান একদিন শ্বাশত সত্য বলে যাহির করেছিল এবং ধর্মগ্রন্থে বর্ণিত আল্লাহর বাণীকে প্রত্যাখ্যান করেছিল। অথচ বিংশ শতাব্দীতে এসে বিজ্ঞানের চরম উৎকর্ষের যুগে বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন বললেন, Science without religion is lame and religion without science is blind অর্থাৎ ধর্মহীন বিজ্ঞান খোড়া এবং বিজ্ঞানহীন ধর্ম অন্ধ।[বিজ্ঞান চর্চায় ইসলামী দৃষ্টিকোণ, (ঢাকা : ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, জুন ২০০১), পৃঃ ৬৩।]
বিজ্ঞান ও ধর্ম পরস্পরের পরিপূরক। এতদুভয়ের মধ্যে বিরোধ বা সংঘর্ষের আশংকা থাকতে পারে না। সুতরাং ধর্মের সাথে বিজ্ঞানের কোন বিরোধ নেই। আবার এই বিজ্ঞানে মুসলমানদের অবদানও অনস্বীকার্য। যা অমুসলিম মনীষীগণও স্বীকার করেছেন। যেমন জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে মুসলমানদের অবদানের কথা স্বীকার করে সার্টন বলেন, মানব সমাজের প্রধান কাজ মুসলমানগণ সাধন করেছেন। শ্রেষ্ঠ গণিতবেত্তা আবু কামিল ও ইবরাহীম ইবনে সিনান ছিলেন মুসলমান। সর্বশ্রেষ্ঠ ভূ-গোলবিদ ও বিশ্বকোষ প্রণেতা আল-মাসঊদী ছিলেন মুসলমান। সর্বশ্রেষ্ঠ ঐতিহাসিক আত-তাবারীও ছিলেন মুসলমান।[অধ্যাপক কে. আলী, মুসলিম সংস্কৃতির ইতিহাস, (ঢাকা: আলী পাবলিকেন্স, ১৯৮১), পৃঃ ২৩১]
আমরা প্রকৃত সত্য উদঘাটনের মানসে সজাগ দৃষ্টি দিলে দেখতে পাই, প্রতিটি বিষয়ে মুসলমানদের অবদান অসামান্য। যেমন আমরা দেখতে পাই বিজ্ঞানে মুসলমানদের ভূমিকার বর্ণনা দিতে গিয়ে মনীষী রবার্ট ব্রিফো নির্দ্বিধায় উল্লেখ করেছেন,
Science is the most momentous contribution of Arab civilization to the modern world. The debt of our science to the Arabs does not consist in starting discoveries or revolutionary theories; Science owes a great deal more to Arab culture it owes its existence.
অর্থাৎ আধুনিক বিজ্ঞান শুধুমাত্র চমকপ্রদ আবিষ্কার বা যুগান্তকারী তত্ত্বকথার জন্যই মুসলমানদের কাছে ঋণী নয়, আধুনিক বিজ্ঞান তার অস্তিত্বের জন্যই মুসলমানদের নিকট চিরঋণী। বলা বাহুল্য, ইসলামের আবির্ভাব না ঘটলে আধুনিক বিজ্ঞানের জন্ম হ’ত না। হ’লেও তা নিশ্চিতরূপে যথেষ্ট বিলম্বিত হ’ত’।[Robert Briffault, The making of History (London; 1934), P. 191.]
অনুরূপভাবে বিখ্যাত পন্ডিত জওহরলাল নেহরুও স্বীকৃতি প্রদান করেছেন,
Among ancients we do not find the scientific method in Egypt or China or India. We find just a dit of it in old Greece. In Rome again it was absent. But the Arabs had this scientific spirit of inquiry and so they may be considered the fathers of modern science.
অর্থাৎ আমরা মিশরীয়, চীনা ও ভারতীয় আদি সভ্যতাগুলোতে বিজ্ঞানের অস্তিত্ব খুঁজে পাই না। তবে প্রাচীন গ্রীস সভ্যতায় এর কিছুটা প্রমাণ মেলে। আর রোম সভ্যতায় তা ছিল রীতিমত অনুপস্থিত। কিন্তু আরবদের মাঝে প্রাণবন্ত, অনুসন্ধিৎসু বিজ্ঞান বিদ্যমান ছিল। সুতরাং তাদেরকে (মুসলিমদেরকে) আধুনিক বিজ্ঞানের জনক বলা যেতে পারে।[Jawaharlal Nehru, Glimpses of world History (London: 1934), P. 154.]
পবিত্র কুরআনে বিভিন্নভাবে মানুষকে বিজ্ঞানের প্রতি উৎসাহিত করা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, عَالِمِ الْغَيْبِ لَا يَعْزُبُ عَنْهُ مِثْقَالُ ذَرَّةٍ فِي السَّمَاوَاتِ وَلَا فِي الْأَرْضِ وَلَا أَصْغَرُ مِن ذَلِكَ وَلَا أَكْبَرُ إِلَّا فِي كِتَابٍ مُّبِينٍ ‘নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের ছোট বড় অণু-পরমাণু এমন কোন বস্ত্ত নেই যার উল্লেখ সুস্পষ্ট কিতাবে (কুরআনে) নেই’ (সাবা ৩)। তিনি অন্যত্র বলেন, انظُرُواْ مَاذَا فِي السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضِ ‘আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে তার প্রতি লক্ষ্য কর’ (ইউনুস ১০১)।
উপরোক্ত আয়াতগুলোতে বিজ্ঞান ভিত্তিক গবেষণার যথেষ্ট খোরাক রয়েছে। জার্মান বৈজ্ঞানিক আইনস্টাইন কুরআনের আয়াতেরই ভাব প্রকাশ করলেন এভাবে, He who can no longer pause to wonder and stand rapt in awe is as good as dead and his eyes are closed.
অর্থাৎ ‘যে মানুষ সৃষ্টি জগতের অবলিলা দেখে বিস্ময়ে স্তম্ভিত হয় না, তার মনে ভয়-ভীতি রেখাপাত করে না, সে যেন মৃতবৎ, দৃষ্টিশক্তি তার রহিত হয়ে গেছে’।[বিজ্ঞান চর্চায় ইসলামী দৃষ্টিকোণ, পৃঃ ৬৭।]
মানুষের সামনে আল্লাহর নিদর্শন সমূহের উল্লেখ করে আল্লাহ বলেন, ‘তাদের জন্য আর একটি নিদর্শন রাত্রি, আমরা তা হ’তে দিনকে বের করে আনি, তৎক্ষণাৎ তারা অন্ধকারে এসে যায় এবং সূর্য তার নিজের অবস্থান স্তরেরও পর নির্দিষ্ট সময়ের জন্য চলেছে, এটা সর্বশক্তিমান সর্বজ্ঞ আল্লাহরই নির্দেশ। চন্দ্রের জন্য আমরা তার মনযিল নির্দিষ্ট করে দিয়েছে, এমনকি অবশেষে তা পুনরায় খেজুরের পুরাতন শুকনা শাখার মত হয়ে যায়। সূর্যের সাধ্য নেই যে, চন্দ্রকে ধরতে পারে এবং রাত্রিরও ক্ষমতা নেই যে, দিনকে অতিক্রম করে। প্রত্যেকে নিজ নিজ কক্ষ পথে চলছে’ (ইয়াসীন ৩৭-৪০)।
উপরোক্ত আলোচনায় সুস্পষ্টভাবে বহুবিধ নিয়মের দৃষ্টান্ত উঠে এসেছে। এসব নিয়ম মহাশূন্যে সূর্য, চন্দ্র, নক্ষত্র সমূহের কার্যাবলী ও গতিবেগ নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। এসব জ্যোতিষ্ক মন্ডলের গঠন ও শৃংখলা দর্শন করলে বিষ্ময়ে অভিভূত হ’তে হয়। বিশ্বভ্রহ্মান্ডে এমন কিছু নেই যারা বিশৃংখলভাবে ঘোরাফেরা করে বেড়াচ্ছে। সবকিছুই সুমহান সৃষ্টিকর্তার নিয়মের আওতায় পরিচালিত হচ্ছে।[Written by a Board of Researchers, Scientific Indication in the Holy Quran (Dhaka: Islamic Foundation Bangladesh, December 1990), p. 173.]
স্বামী বিবেকানন্দ এ সত্যটি স্বীকার করে বলেন, মুর নামক মুসলমান জাতি স্পেন (Spain) দেশে অতি সুসভ্য রাজ্য স্থাপন করলে, নানা বিদ্যা চর্চা করলে ইউরোপে প্রথম ইউনিভার্সিটি হ’ল। ইতালি, ফ্রান্স, সুদূর ইংল্যান্ড হ’তে বিদ্যা শিখতে এল। বাড়ি-ঘরদোর সব নতুন ঢঙে বনতে লাগল।[বাজেয়াপ্ত ইতিহাস, পৃঃ ৫১।] শ্রী মানবেন্দ্রনাথ রায় বলেন, Leaming form the Muslim Europe became the leader of modern civilization. অর্থাৎ মুসলিম শিক্ষার প্রভাবেই ইউরোপ আধুনিক সভ্যতার নেতা হ’তে পেরেছে।[চেপে রাখা ইতিহাস, পৃঃ ১৯।]
আলোচনার শেষ প্রান্তে এসে এ কথাই বলতে হয় যে, আধুনিক বিজ্ঞানে মুসলমানদের ভূমিকা অপরিসীম। যার সত্যতা অমুসলিম জ্ঞান সাধকরাও অকপটে স্বীকার করেছেন। শিক্ষা-সভ্যতা, কুরআন-সুন্নাহ, দর্শন, চিকিৎসা বিজ্ঞান, রসায়ন, ভূগোল, জ্যোতির্বিদ্যা, গণিত প্রভৃতি বিদ্যায় ছিল মুসলিম বিজ্ঞানীদের অবাধ বিচরণ। কালক্রমে ইহুদী-খ্রীষ্টানদের ষড়যন্ত্রের শিকারে পরিণত হয়ে মুসলিম সভ্যতার পতন ঘটে। সাথে সাথে সব কিছুই চলে যায় তাদের নিয়ন্ত্রণে। পিছিয়ে পড়ে মুসলিম জাতি। যা আজও পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে পারেনি। তাই বলে তাদের অতীত অবদানকে অস্বীকার করা যায় না। প্রতিটি জিনিসের সূচনাকারীর স্থান সর্বগ্রে এটা চির সত্য কথা।
ইসলাম বিজ্ঞানের প্রতিবন্ধক নয়, বরং ইসলাম বিজ্ঞানকে ঢেলে সাজাতে অসামান্য ভূমিকা পালন করেছে। তাই আমরা বলতে পারি, বিশ্ব সভ্যতায় ইসলামের অবদান সর্বাধিক। এ প্রসঙ্গে আধুনিক পন্ডিত মিঃ ব্রিফল্ট-এর মন্তব্য পেশ করে আলোচনার শেষ করতে পারি, Science is the most momentous contribution of Arab civilization to the modern world. ‘আধুনিক বিশ্বের জন্য বিজ্ঞান হ’ল আরব সভ্যতার সর্বশ্রেষ্ঠ দান’।[বিজ্ঞান চর্চায় ইসলামী দৃষ্টিকোণ, পৃঃ ৩০৪] তিনি আরো জোর দিয়ে বলেন, European Science owes its existence to the Arabs. অর্থাৎ ‘ইউরোপীয় বিজ্ঞান তার অস্তিত্বের জন্যই আরবদের তথা মুসলমানদের নিকট চিরঋণী’।[বিজ্ঞান চর্চায় ইসলামী দৃষ্টিকোণ, পৃঃ ৩০৪]