গীবত থেকে নিজেকে রক্ষা করুন !

গীবত অর্থ হ’ল পরচর্চা, দোষচর্চা, পরনিন্দা এবং তোহমত অর্থ হ’ল মিথ্যা অপবাদ আরোপ করা। এ বিষয় দুটির কারণে সমাজে নানা বিশৃঙ্ক্ষলা সৃষ্টির হয়। অথচ উভয়টিই কবীরা গোনাহ ও বান্দার সাথে সংশ্লিষ্ট। বান্দা ক্ষমা না করলে আল্লাহ এ গোনাহ মাফ করবেন না। কারণ এর মাধ্যমে মানুষের ইয্যত-সম্মান নষ্ট হয়, তার হক্ব বিনষ্ট হয়। অনেকে দোষচর্চা করে মনে করেন তিনি সঠিক কথাইতো বলেছেন। সুতরাং তার দোষের হবে কেন? অথচ কারো মধ্যে থাকা দোষ-ত্রুটি তার অবর্তমানে আলোচনা করাই গীবত। গীবত বা দোষচর্চা থেকে আল্লাহ নিষেধ করেছেন। তিনি বলেন,وَلَا يَغْتَبْ بَعْضُكُمْ بَعْضًا أَيُحِبُّ أَحَدُكُمْ أَنْ يَأْكُلَ لَحْمَ أَخِيهِ مَيْتًا فَكَرِهْتُمُوْهُ، ‘আর একে অপরের পিছনে গীবত করো না। তোমাদের কেউ কি তার মৃত ভাইয়ের গোশত খেতে পসন্দ করে? বস্তুতঃ তোমরা সেটি অপসন্দ করে থাক’ (হুজুরাত ৪৯/১২)

তোহমত বা অপবাদ সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন,وَمَنْ يَكْسِبْ خَطِيئَةً أَوْ إِثْمًا ثُمَّ يَرْمِ بِهِ بَرِيئًا فَقَدِ احْتَمَلَ بُهْتَانًا وَإِثْمًا مُبِينًا، ‘যে ব্যক্তি কোন অপরাধ কিংবা পাপ করে, অতঃপর তা কোন নির্দোষ ব্যক্তির উপর চাপায়, সে নিজেই উক্ত অপবাদ ও প্রকাশ্য পাপভার বহন করবে’ (নিসা ৪/১১২)। তিনি আরো বলেন,إِنَّمَا يَفْتَرِي الْكَذِبَ الَّذِينَ لَا يُؤْمِنُونَ بِآيَاتِ اللهِ وَأُولَئِكَ هُمُ الْكَاذِبُونَ، ‘মিথ্যা তো কেবল তারাই রচনা করে যারা আল্লাহর আয়াত সমূহে বিশ্বাস করে না এবং তারাই মিথ্যাবাদী’ (নাহল ১৬/১০৫)

গীবত ও তোহমত থেকে নিজেকে যথা সাধ্য রক্ষা করতে হবে। এর ভয়াবহতা ভীষম চরম পর্যায়ে ।  আবূ হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, أَتَدْرُونَ مَا الْغِيبَةُ قَالُوا اللهُ وَرَسُولُهُ أَعْلَمُ قَالَ ذِكْرُكَ أَخَاكَ بِمَا يَكْرَهُ قِيلَ أَفَرَأَيْتَ إِنْ كَانَ فِى أَخِى مَا أَقُولُ قَالَ إِنْ كَانَ فِيهِ مَا تَقُولُ فَقَدِ اغْتَبْتَهُ وَإِنْ لَمْ يَكُنْ فِيهِ فَقَدْ بَهَتَّهُ. ‘তোমরা কি জান গীবত কাকে বলে? তারা বলল, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই ভালো জানেন। তিনি বললেন, তোমার মুসলিম ভাই সম্পর্কে এমন কথা বলা, যা সে অপসন্দ করে। জিজ্ঞেস করা হ’ল, যদি আমার ভাইয়ের মধ্যে সে ত্রুটি বিদ্যমান থাকে, যা আমি বলি? তিনি বললেন, তুমি যে দোষ-ত্রুটির কথা বললে, তার মধ্যে সে দোষ-ত্রুটি থাকলেই তুমি তার গীবত করলে। আর যদি দোষ-ত্রুটি বিদ্যমান না থাকে, তবে তুমি মিথ্যারোপ করলে’। (মুসলিম হা/২৫৮৯; ছহীহুল জামে‘ হা/৮৬; ছহীহাহ হা/১৪১৯)

অনুরূপভাবে রাসূল (ছাঃ) গীবত থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। ’আবদুল্লাহ ইবনু ’উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদিন রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মিম্বারের উপর উঠলেন এবং উচ্চস্বরে ডেকে বললেন, ’’হে মুসলিমগণ! যারা মুখে ইসলাম গ্রহণ করেছ এবং অন্তরে ইসলামের প্রভাব রাখোনি, তোমরা মুসলিমদেরকে কষ্ট দিয়ো না, তাদেরকে লজ্জা দিয়ো না এবং তাদের দোষ অন্বেষণ করো না। কেননা যে ব্যক্তি কোন মুসলিমের দোষ অন্বেষণ করে, আল্লাহ তা’আলা তার দোষ অন্বেষণ করেন। আল্লাহ তা’আলা যার দোষ খুঁজবেন, তাকে অপমান করবেন, যদি সে নিজের ঘরের মধ্যেও থাকে। (তিরমিযী হা/২০৩২; মিশকাত হা/৫০৪৪)

তোমরা তাদেরকে লজ্জা দিয়ো না’। যদি লজ্জা দেয় তবে এটা তাদের জন্য ধমক ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে গণ্য হবে। কেউ কাউলে লজ্জা দিলে তাকে এ কাজ হতে তাওবাহ্ করতে হবে। আবার কখনও লজ্জা দেয়ার জন্য তাকে হাদ্দ বা শাস্তি অথবা তা‘বীর বা শিক্ষা দেয়ার জন্য শাস্তি দেয়া ওয়াজিব হবে। এটা হবে সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধের দিক থেকে। (তুহফাতুল আহ্ওয়াযী ৬ষ্ঠ খন্ড, হাঃ ২০৩২)

ইমাম নাবাবী (রহিমাহুল্লাহ) বলেনঃ الْمُحَاكَاة তথা অন্যের মন্দ কিছু বর্ণনা করা নিষিদ্ধ গীবতের অন্তর্ভূক্ত। যেমন- কেউ খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাঁটে অথবা মাথা নীচু করে হাঁটে ইত্যাদি অঙ্গ-ভঙ্গিমা প্রদর্শন করা। (মিরক্বাতুল মাফাতীহ)

গীবত হলো মানুষের গোশত ভক্ষণ করা :

রাসূল (ছাঃ) পার্থিব শাস্তির বিশদ বর্ণনা দিয়েছেন। আনাস ইবনে মালিক (রাঃ) বলেন, আরবরা সফরে গেলে একে অপরের খিদমত করত। আবুবকর ও ওমর (রাঃ)-এর সাথে একজন লোক ছিল যে তাদের খিদমত করত। তারা ঘুমিয়ে পড়লেন। অতঃপর জাগ্রত হ’লে লক্ষ্য করলেন যে, সে তাদের জন্য খাবার প্রস্ত্তত করেনি (বরং ঘুমিয়ে আছে)। ফলে একজন তার অপর সাথীকে বললেন, এতো তোমাদের নবী করীম (ছাঃ)-এর ন্যায় ঘুমায়। অন্য বর্ণনায় আছে, তোমাদের বাড়িতে ঘুমানোর ন্যায় ঘুমায় (অর্থাৎ অধিক ঘুমায়)। অতঃপর তারা তাকে জাগিয়ে বললেন, তুমি রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট গমন করে তাঁকে বল যে, আবুবকর ও ওমর (রাঃ) আপনাকে সালাম প্রদান করেছেন এবং আপনার নিকট তরকারী চেয়েছেন।

রাসূল (ছাঃ) তাকে বললেন, যাও, তাদেরকে আমার সালাম প্রদান করে বলবে যে, তারা তরকারী খেয়ে নিয়েছে। (একথা শুনে) তারা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে নবী করীম (ছাঃ)-এর নিকট গমন করে বলল, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আমরা আপনার নিকট তরকারী চাইতে ওকে পাঠালাম। অথচ আপনি তাকে বলেছেন, তারা তরকারী খেয়েছে। আমরা কি তরকারী খেয়েছি? তিনি বললেন, তোমাদের ভাইয়ের গোশত দিয়ে। যাঁর হাতে আমার প্রাণ তাঁর কসম করে বলছি, নিশ্চয়ই আমি তোমাদের উভয়ের দাঁতের মধ্যে তার গোশত দেখতে পাচ্ছি। তারা বললেন, আমাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করুন। তিনি বললেন, না বরং সেই তোমাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করবে’। (সিলসিলা ছহীহাহ হা/২৬০৮)

আয়েশা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা আমি নবী করীম (ছাঃ)-কে বললাম, আপনার জন্য ছাফিয়ার এই এই হওয়া যথেষ্ট। কোন কোন বর্ণনাকারী বলেন, তাঁর উদ্দেশ্য ছিল ছাফিয়া বেঁটে। একথা শুনে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, তুমি এমন কথা বললে, যদি তা সমুদ্রের পানিতে মিশানো হয়, তাহ’লে তার স্বাদ পরিবর্তন করে দেবে’। (আবূদাঊদ হা/৪৮৭৫; মিশকাত হা/৪৮৫৭; ছহীহুত তারগীব হা/২৮৩৪)

ক্বায়েস বলেন, আমর ইবনুল আছ (রাঃ) তার কতিপয় সঙ্গী-সাথীসহ ভ্রমণ করছিলেন। তিনি একটি মৃত খচ্চরের পাশ দিয়ে অতিক্রম করছিলেন, যা ফুলে উঠেছিল। তখন তিনি বললেন, আল্লাহর কসম! কোন ব্যক্তি যদি পেট পুরেও এটা খায়, তবুও তা কোন মুসলমানের গোশত খাওয়ার চেয়ে উত্তম’।(আল-আদাবুল মুফরাদ হা/৭৩২, সনদ ছহীহ)

গীবতকারীর পরোকালে শাস্তির নমুনা :

কোন মুসলিমের গীবত করার কারণে যে তার সাথে শত্রুতা রাখে তার কাছে এ মুসলিমের মান-সম্মান খাটো করার কারণে অথবা তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়ে এক গস্নাস বা এক বেলা খাদ্য গ্রহণ করল, মহান আল্লাহ তাকে জাহান্নামের আগুন থেকে এ পরিমাণ খাওয়াবেন। রাসূল (ছাঃ) উম্মতকে গীবতের পরকালীন শাস্তি সম্বন্ধেও অবহিত করেছেন। আনাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,لَمَّا عُرِجَ بِى مَرَرْتُ بِقَوْمٍ لَهُمْ أَظْفَارٌ مِنْ نُحَاسٍ يَخْمِشُونَ وُجُوهَهُمْ وَصُدُورَهُمْ فَقُلْتُ مَنْ هَؤُلاَءِ يَا جِبْرِيلُ قَالَ هَؤُلاَءِ الَّذِينَ يَأْكُلُونَ لُحُومَ النَّاسِ وَيَقَعُونَ فِى أَعْرَاضِهِمْ- ‘মি‘রাজে গিয়ে আমাকে এমন কিছু লোকের পাশ দিয়ে নিয়ে যাওয়া হ’ল যাদের নখগুলি সব ছিল পিতলের। যা দিয়ে তারা তাদের মুখ ও বুক খামচাচ্ছিল। আমি জিব্রীলকে বললাম, এরা কারা? তিনি বললেন, যারা মানুষের গোশত খেত অর্থাৎ গীবত করত এবং তাদের সম্মান নষ্ট করত’।(আবূদাঊদ হা/৪৮৭৮-৭৯; মিশকাত হা/৫০৪৬; ছহীহাহ হা/৫৩৩)

‘আল্লামা ত্বীবী (রহিমাহুল্লাহ) বলেনঃ রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মি‘রাজে গিয়ে দেখলেন জাহান্নামে কিছু লোক মুখ ও বক্ষ আঁচড়াতে রত। প্রকৃতপক্ষ মুখ ও বক্ষ আঁচড়ানো স্বভাবটা বিলাপ করে ক্রন্দনকারী মহিলাদের স্বভাব। অথচ যারা দুনিয়াতে গীবত করেছে এবং মুসলিমদের মান-সম্মান ক্ষুণ্ণ করার চেষ্টা করেছে, এরা প্রকৃতপক্ষ পুরুষের গুনাগুণ সম্বলিত না। বরং তারা মহিলাদের মন্দ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হওয়ায় তাদেরকে মহিলাদের মতো সাজা দেয়া হচ্ছে। (মিরক্বাতুল মাফাতীহ)

কোন মুসলিমের গীবত করার কারণে যে তার সাথে শত্রুতা রাখে তার কাছে এ মুসলিমের মান-সম্মান খাটো করার কারণে অথবা তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়ে এক গ্রাস বা এক বেলা খাদ্য গ্রহণ করল, আল্লাহ তা‘আলা তাকে জাহান্নামের আগুন থেকে এ পরিমাণ খাওয়াবেন। রাসূল (ছাঃ) বলেন,مَنْ أَكَلَ بِرَجُلٍ مُسْلِمٍ أَكْلَةً فَإِنَّ اللهَ يُطْعِمُهُ مِثْلَهَا مِنْ جَهَنَّمَ وَمَنْ كُسِىَ ثَوْبًا بِرَجُلٍ مُسْلِمٍ فَإِنَّ اللهَ يَكْسُوهُ مِثْلَهُ مِنْ جَهَنَّمَ وَمَنْ قَامَ بِرَجُلٍ مَقَامَ سُمْعَةٍ وَرِيَاءٍ فَإِنَّ اللهَ يَقُومُ بِهِ مَقَامَ سُمْعَةٍ وَرِيَاءٍ يَوْمَ الْقِيَامَةِ- ‘যে ব্যক্তি কোন মুসলমানের গীবতের বিনিময়ে এক গ্রাসও খাদ্য ভক্ষণ করবে, আল্লাহ তাকে সমপরিমাণ জাহান্নামের আগুন ভক্ষণ করাবেন। আর যে ব্যক্তি কোন মুসলমানকে অপমান করার বিনিময়ে কোন কাপড় পরিধান করবে, আল্লাহ তাকে সমপরিমাণ জাহান্নামের আগুন পরিধান করাবেন। আর যে ব্যক্তি কাউকে হেয় প্রতিপন্ন করে লোকদের নিকট নিজের বড়ত্ব যাহির করে এবং শ্রেষ্ঠত্ব দেখায়, ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহ স্বয়ং ঐ ব্যক্তির শ্রুতি ও রিয়া প্রকাশ করে দেবার জন্য দন্ডায়মান হবেন’। (আবূদাঊদ হা/৪৮৮১; মিশকাত হা/৫০৪৭ ‘শিষ্টাচার সমূহ’ অধ্যায়; ছহীহাহ হা/৯৩৪)

যে ব্যক্তি কোন ব্যক্তিকে দিয়ে তাকওয়া ও বুজুর্গ প্রকাশ করল যাতে করে মানুষ তার ব্যাপারে সুধারণা বা উত্তম বিশ্বাস রাখে যে, সে একজন মুত্তাক্বী ব্যক্তি, তাকে সম্মানী ভাবুক এবং লোকেরা তার খিদমাত করুক, নিজের শ্রেষ্ঠত্ব দেখায় যাতে লোকেরা বিশ্বাস করে যে, লোকটি বিরাট মর্যাদার অধিকারী। অনেক সম্পদশালী, এটা দ্বারা তার উদ্দেশ্য হলো লোকেরা তাকে বেশি টাকা প্রদান করুক, তাকে সম্মান করুক তবে কিয়ামতের দিন স্বয়ং আল্লাহ তার ত্রুটি-বিচ্যুতি ও দুর্বলতা শোনানোর জন্য এবং দেখানোর জন্য দাঁড় করাবেন (একজন ফেরেশতাকে)। (মিরক্বাতুল মাফাতীহ; ‘আওনূল মা‘বূদ ৮ম খন্ড, হাঃ ৪৮৭৩)

মুমিন ব্যতীত অন্যদের সাথে মেলামেশা কমিয়ে দেওয়া প্রকৃত মুমিন ব্যক্তির জন্য ওয়াজিব। বর্তমান সময়ে নারীর চেয়ে পুরুষ মানুষ বেশী বেশী গীবত-তোহমতে ব্যস্ত থাকে, যা প্রকৃত মুমিন ব্যক্তির জন্য অনুচিৎ। প্রকৃত মুমিন ব্যক্তি তারাই যারা দ্বীনের সৌন্দর্য্যর প্রতি লক্ষ্য রাখে এবং অপ্রসঙ্গিক ও গর্হি ত কাজ এড়িয়ে চলেন। আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে দ্বীনের সঠিক বুঝ দান করুন এবং গীবত ও তোহমত থেকে রক্ষা করুন, আমীন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

loader-image

Scroll to Top