কোমলতা ও সদাচরণ

সদাচরণ মানব চরিত্রের এক অমূল্য অর্জন। সদাচরণ এমন একটি গুণ যাতে লুকিয়ে আছে ধৈর্য, বিনয়-নম্রতা, আত্মীয়তার সম্পর্ক অক্ষুণ্ণ রাখা, প্রতিবেশীর অধিকার রক্ষা, পরিবার, প্রতিষ্ঠান ও সমাজ চালানোর যোগ্যতা, সর্বোপরি আত্মিক মযবুতির বড় উপকরণ। রাসূল (ছাঃ) বলেন,إِنَّ اللهَ رَفِيقٌ يُحِبُّ الرِّفْقَ وَيُعْطِى عَلَى الرِّفْقِ مَا لاَ يُعْطِى عَلَى الْعُنْفِ وَمَا لاَ يُعْطِى عَلَى مَا سِوَاهُ ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ কোমল। তিনি কোমলতাকে ভালবাসেন। কোমলতার উপর তিনি যা দেন, কঠোরতা ও অন্য জিনিসের উপর তা দেন না’।[মুসলিম হা/২৫৯৩]

আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন,  এক বেদুঈন মসজিদের ভিতর প্রস্রাব করে দিলে লোকেরা তাকে ধমকানোর জন্য উঠে দাঁড়াল। রাসূল (ছাঃ) বললেন, তাকে ছেড়ে দাও। প্রস্রাবের উপর এক বালতি পানি ঢেলে দাও। কারণ তোমাদেরকে সহজ নীতি অবলম্বনের জন্য পাঠানো হয়েছে। কঠোর নীতি অবলম্বনের জন্য নয়’।[বুখারী হা/২২০]

লোকটি এখানে কয়েকটি অন্যায় করেছে- ১. নির্লজ্জতার পরিচয় দিয়েছে, ২. মসজিদ অপবিত্র করেছে, ৩. রাসূল (ছাঃ)-এর সামনে চরম বেয়াদবী করেছে, ৪. সমাজ বহির্ভূত কাজ করেছে ইত্যাদি।

এক কথায়, সে তার উক্ত কাজে সকলকে হতভম্ব করে দিয়েছে। অথচ এরপরেও সৃষ্টির সর্বসেরা মানুষ (রাসূল (ছাঃ), তাতে সহজ নীতি অবলম্বন করার পরামর্শ দিলেন। কত সুমহান সদাচরণ! কত উন্নত শিক্ষা! হাদীছের শিক্ষা কত অসীম, ভাবতেই গা শিউরে ওঠে। দ্বীন মানুষকে বিনয়ী করে। তাই সুন্দর আচরণের জবাবে সুন্দর আচরণকে সদাচারাণ বলে না। বরং মন্দ আচরণের বিপরীতে সুন্দর আচরণকে সদাচারণ বলে। দ্বীন লেবাসে নয়, আচরণে প্রকাশ পায়।

আমর ইবনু ’আবাসাহ্ (রাঃ) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর খিদমাতে উপস্থিত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,

১. হে আল্লাহর রসূল! এ দ্বীনের দা’ওয়াতের ব্যাপারে একেবারে প্রথম দিকে আপনার সাথে আর কারা ছিলেন? তিনি বললেন, আযাদ ব্যক্তি আবূ বকর ও একজন গোলাম বিলাল।

2. আমি পুনরায় জিজ্ঞেস বললাম, ইসলামের নিদর্শন কী? তিনি বললেন, মার্জিত কথাবার্তা বলা ও অভুক্তকে আহার করানো। অতঃপর আমি জিজ্ঞেস করলাম, ঈমানের পরিচয় কী? তিনি বললেন, গুনাহের কাজ থেকে বিরত হয়ে ধৈর্য ধরা ও দান করা। 3. আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, কোন্ ইসলাম উত্তম? তিনি বললেন, যার হাত ও জিহ্বার অনিষ্ট হতে অন্য মুসলিম নিরাপদ থাকে।

৪. আমি পুনরায় জিজ্ঞেস করলাম, কোন্ ঈমানের কোন্ শাখা উত্তম? তিনি বললেন, সৎস্বভাব। আমি জিজ্ঞেস করলাম, সালাতে কোন্ জিনিস উত্তম? তিনি বললেন, দীর্ঘ সময় নিয়ে ক্বিয়াম করা।

৫. আমি জিজ্ঞেস করলাম, কোন্ হিজরত উত্তম। উত্তরে তিনি বললেন, আল্লাহ তা‘আলা যা অপছন্দ করে তুমি এমন কাজ ছেড়ে দিবে।

৬. আমি বললাম, কোন্ জিহাদ উত্তম? তিনি বললেন, যার ঘোড়ার হাত-পা কর্তিত এবং নিজের রক্ত নির্গত হয়েছে অর্থাৎ- সে ব্যক্তি সর্বোত্তম যার ঘোড়া যুদ্ধে মারা যায় এবং সেও শহীদ হয়।

৭. আমি বললাম, সর্বোত্তম কোন্ সময়? তিনি উত্তরে বললেন, শেষ রাতের মধ্যভাগ। (আহমাদ হা/১৮৯৪২, মিশকাত হা/৪৬)

ব্যাখ্যা : উত্তম কথা বলা ও খাদ্য খাওয়ানো- এ দু’টি বিষয়ের মধ্যে উত্তম চরিত্রের প্রতি উৎসাহ প্রদান এবং দয়া প্রদর্শনের প্রতি ইঙ্গিত রয়েছে। যদি তা মিষ্টি কথার মাধ্যমেও হয়।

ইমাম ত্বীবী বলেন, এ হাদীসে ঈমানকে ধৈর্য ও দানশীলতা দ্বারা ব্যাখ্যা করা হয়েছে। কেননা ধৈর্য নিষিদ্ধ কাজ পরিত্যাগ করার আর দানশীলতা আদিষ্ট কাজ বাস্তবায়নের প্রমাণ বহন করে।

হাসান বসরী (রহঃ) ব্যাখ্যা করেছেন। এ দু’টি অভ্যাসের সাথে উত্তম চরিত্রকে সংযোজন করা হয়েছে। এর ভিত্তি হলো ‘আয়িশাহ্ (রাঃ)-এর বাণী ‘‘রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর চরিত্র ছিল আল-কুরআন’’ অর্থাৎ- তিনি তা পালন করেন আল্লাহ তাঁকে যে আদেশ প্রদান করেছেন, আর তা থেকে বিরত থাকেন আল্লাহ যা করতে নিষেধ করেছেন। কোন্ ইসলাম উত্তম, অর্থাৎ- কোন্ শ্রেণীর মুসলিম অধিক সাওয়াবের অধিকারী।

خُلُقٌ এমন ক্ষমতা বা যোগ্যতাকে বলা হয় যার কারণে কোন ব্যক্তির দ্বারা সহজেই কোন কাজ সম্পাদন হয়। কোন্ সালাত উত্তম? এর জওয়াবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘দীর্ঘ কুনূত’’, অর্থাৎ- দীর্ঘ ক্বিয়াম অথবা ক্বিরাআত বা নম্রতা। তবে প্রথম অর্থটিই অধিক প্রকাশমান।

কোন্ হিজরত উত্তম? এ প্রশ্নের কারণ এই যে, হিজরত অনেক প্রকারের রয়েছে। উত্তরে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তুমি তা পরিত্যাগ করবে যা তোমার রব অপছন্দ করেন। এ প্রকারের হিজরত উত্তম এজন্য যে তা ব্যাপক।

কোন্ প্রকারের জিহাদ বা কোন্ ধরনের মুজাহিদ উত্তম? এর জওয়াবে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, জিহাদে যার ঘোড়া নিহত হয়েছে এবং তার নিজের রক্ত প্রবাহিত হয়েছে সেই উত্তম মুজাহিদ। এ মুজাহিদ এজন্য উত্তম যে, সে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য সম্পদও ব্যয় করেছেন এবং নিজেও শাহীদ হয়েছেন।

(جَوْفُ اللَّيْلِ الْاۤخِرُ) দ্বারা উদ্দেশ্য রাতের ২য় ভাগের মধ্যাংশ। আর তা হলো রাতের ছয় ভাগের কম সময়। আর রাতের এ অংশেই আল্লাহ তা‘আলা দুনিয়ার আকাশে নেমে আসেন। ইমাম তিরমিযী (রহঃ) ‘আমর ইবনু ‘আবাসাহ্  (রাঃ) হতে বর্ণিত নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে বর্ণনা করেন, ‘‘শেষ রাতের মধ্যভাগে মহান রব বান্দার অতি নিকটবর্তী হন। যারা এ সময়ে আল্লাহর স্মরণে মত্ত থাকে তুমি সক্ষম হলে তাদের অন্তর্ভুক্ত হও’’।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

loader-image

Scroll to Top