’আয়িশাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, মুহাম্মাদ (সা.) -এর পরিবারবর্গ লাগাতার দু’দিন যবের রুটি খেয়ে পরিতৃপ্ত হননি এমতাবস্থায় রাসূলুল্লাহ (সা.) -এর মৃত্যু হয়েছে। (বুখারী হা/ ৫৪১৬, মুসলিম হা/২৯৭০, মিশকাত হা/৫২৩৭)
ব্যাখ্যা : রাসূলুল্লাহ (সা.) -এর পরিবার হলো তার পূতপবিত্র স্ত্রীগণ এবং তাদের খাদিমগণ। যব গমের তুলনায় কম মূল্যমানের, যবের রুটিই যেহেতু পাননি তাহলে গমের রুটির তো প্রশ্নই ওঠে না। রাসূলুল্লাহ (সা.) দু’দিন একাধারে পেট পুরে খেতে পাননি, একদিন পেটপুরে খেলে অন্যদিনে উপোষ থাকতেন। এটা এজন্য যে, আল্লাহ তা’আলা জমিনের ধনভাণ্ডারের চাবি তার কাছে পেশ করেছিলেন এবং মক্কার একটি পাহাড়কে স্বর্ণে পরিণত করে তার নিকট পেশ করেছিলেন কিন্তু তিনি এ কথা বলে দরিদ্রতাকেই গ্রহণ করে নিয়েছেন যে, আমি একদিন ক্ষুধার্ত থেকে সবর করব, আরেকদিন খেয়ে পরিতৃপ্ত হয়ে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করব। কেননা ঈমান দুই অংশে বিভক্ত, এক অংশ সবরের মধ্যে, অন্য অংশ শুকরিয়ার মধ্যে; যেমন আল্লাহ বলেছেন : (اِنَّ فِیۡ ذٰلِکَ لَاٰیٰتٍ لِّکُلِّ صَبَّارٍ شَکُوۡرٍ) “নিশ্চয় তাতে উপদেশ রয়েছে প্রত্যেক ধৈর্যশীল এবং কৃতজ্ঞ বান্দাদের জন্য।” (সূরাহ্ ইবরাহীম ১৪ : ৫, লুকমান ৩১ : ৩১, আশ শুআরা- ২৬ : ৩৩)।
রাসূলুল্লাহ (সা.) -এর এ অবস্থা মৃত্যু পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। এমনকি তিনি মৃত্যুর পূর্বে তার বর্মটি এক ইয়াহূদীর কাছে বন্ধক রেখে সামান্য কয়েক সা’ যব ধার গ্রহণ করেছিলেন। অনেকে বলে থাকেন রাসূলুল্লাহ (সা.) শেষ জীবনে ধনী হয়ে গিয়েছিলেন। উপযুক্ত হাদীস দ্বারা তাদের এ দাবী প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। হ্যা, তাঁর হাতে অনেক সম্পদ এসেছিল কিন্তু সেগুলো তিনি নিজের জন্য সংরক্ষণ করেননি বরং আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য সব খরচ করে দিয়েছেন। অবশ্য তিনি সদা সর্বদা অন্তরের ধনী ছিলেন। (মিরকাতুল মাফাতীহ; ফাতহুল বারী ১১ খণ্ড, হা. ৬৪৫৪; আল কাশিফ ১০ম খণ্ড, ৩৩১১ পৃ.)
(২) আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। একদিন তিনি নাবী (সা.) -এর কাছে কিছু যবের রুটি ও গন্ধময় পুরাতন চর্বি নিয়ে আসলেন। এদিকে নাবী (সা.) মদীনার এক ইয়াহূদীর কাছে নিজের লৌহবর্মটি গচ্ছিত রেখে পরিবারবর্গের জন্য কিছু যব ঋণ এনেছিলেন। (অধস্তন) বর্ণনাকারী বলেন, আমি আনাস (রাঃ)-কে এটাও বলতে শুনেছি যে, মুহাম্মাদ (সা.) -এর পরিবারের কাছে কোন সন্ধ্যাকালেই এক সা’ গম বা এক সা’ কোন খাদ্য দানা (আগামীকালের জন্য) মওজুদ থাকত না। অথচ তার স্ত্রী ছিলেন ৯ জন। (বুখারী হা/২০৬৯, মিশকাত হা/৫২৩৯)।
ব্যাখ্যা : আনাস (রাঃ) প্রায়ই বিভিন্ন খানা খাদ্য রাসূলুল্লাহ (সা.) -এর দরবারে নিয়ে আসতেন। তার মা উম্মু সুলায়ম (রাঃ) মাঝে মধ্যে বাড়িতে খানা তৈরি করেও আনাস-কে পাঠিয়ে রাসূলুল্লাহ (সা.) -কে বাড়ীতে ডেকে নিয়ে খাওয়াতেন।
রাসূলুল্লাহ (সা.) ইয়াহূদীর নিকট লৌহবর্ম বন্ধক রেখে পরিবারের জন্য কয়েক সা’ যব নিয়েছিলেন। এটা ছিল একেবারে জীবনের শেষ প্রান্তে। আর তা এজন্য যে, যাতে তার অবস্থা মানুষের কাছে গোপন থাকে অথবা সাহাবীগণ লজ্জায় তাকে সাহায্য না করেন। সর্বোপরি হাত পাতা বা চাওয়া থেকে নিজকে পবিত্র রাখা এবং উম্মাতের নিকট তার কাজের বিনিময় নেয়া থেকে পবিত্র থাকাই উদ্দেশ্য। আল্লাহ বলেন, (اِنَّ فِیۡ ذٰلِکَ لَاٰیٰتٍ لِّکُلِّ صَبَّارٍ شَکُوۡرٍ)
“আর আমি তোমাদের নিকট কোন বিনিময় চাচ্ছি , আমার বিনিময় তো বিশ্বপ্রতিপালকের নিকট রয়েছে।” (সূরাহ আশ শুআরা- ২৬ : ১০৯, ১২৭)
রাসূলুল্লাহ (সা.) -এর নয়জন স্ত্রী একত্রে ছিলেন, তাদের দিন-কাল এভাবে অতিবাহিত হত যে, কারো ঘরেই আগামীকালের জন্য এক সা’ গম কিংবা অন্য কিছু খাদ্য দানা সঞ্চয় রেখে রাত শুরু হত না। (মিরকাতুল মাফাতীহ; ফাতহুল বারী ৪র্থ খণ্ড, হা. ২০৬৯; আল কাশিফ ১০ম খণ্ড, ৩৩১১পৃ)
(৩) উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদিন আমি রসূলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে উপস্থিত হয়ে দেখলাম তিনি একখানা খেজুর পাতার চাটাইয়ের উপর শুয়ে আছেন। তাঁর ও চাটাইয়ের মাঝে কোন বিছানা ছিল না। ফলে চাটাই তাঁর দেহে চিহ্ন বসিয়ে দিয়েছিল। আর তিনি ঠেস দিয়েছিলেন (খেজুর গাছের) আঁশপূর্ণ একটি চামড়ার বালিশের উপর। আমি বললাম : হে আল্লাহর রসূল! আল্লাহর কাছে দু’আ করুন তিনি যেন আপনার উম্মাতকে সচ্ছলতা প্রদান করেন। পারসিক ও রোমীয়গণকে সচ্ছলতা প্রদান করা হয়েছে, অথচ তারা (কাফির) আল্লাহর ইবাদত করে না। (এ কথা শুনে) রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন : হে খত্ত্বাব-এর পুত্র! তুমি কি এখনো এ ধারণায় রয়েছ? তারা তো এমন এক সম্প্রদায়, যাদেরকে পার্থিব জীবনে নিআমাতসমূহ আগাম প্রদান করা হয়েছে। অপর এক বর্ণনায় আছে- তুমি কি এতে সন্তুষ্ট নও যে, তারা দুনিয়াপ্রাপ্ত হোক আর আমাদের জন্য থাকুক পরকাল? (বুখারী হা/৪৯১৩, মিশকাত হা/৫২৪০)।
ব্যাখ্যা : (رِمَالِ حَصِيرٍ) এর অর্থ খেজুর পাতা দ্বারা বানানো চাটাই। রাসূলুল্লাহ (সা.) -এর রাজকীয় খাটপালঙ্কে শয়নের কথা, কিন্তু তিনি দুনিয়ার এসব বিলাস-ব্যসনের প্রতি মোটেও ভ্রুক্ষেপ করেননি। তিনি সাদাসিধে মাটিতে খেজুর পাতার চাটাইয়ের উপর শুয়ে থাকতেন। এটাও ছিল নিখাদ চাটাইয়ের উপর শোয়া। এই চাটাইয়ের উপর চাদর কিংবা কম্বল কিছুই ছিল না, ফলে চাটাইয়ের দাগ তাঁর দেহে লেগে যেত। বালিশটিও কি নরম বা আরামদায়ক ছিল? মোটেও না; চামড়ার খোলশে খেজুরের ছাল, কোন মত মাথাটা বিছানা থেকে একটু উঁচু করে শোবার ব্যবস্থা।
‘উমার (রাঃ) রোম-পারস্যবাসীর সুখ-সমৃদ্ধির কথা তুলে আল্লাহর কাছে দু’আ করতে বললেন যে, হে আল্লাহর রসূল! আপনার উম্মতেরা আল্লাহর ইবাদত করে তারা কেন দরিদ্র থাকবে, আল্লাহ তা’আলা যেন তাদের সম্পদ বাড়িয়ে দেন। আল্লাহর রসূল তার উত্তরে উক্ত কথাগুলো বলেন। অর্থাৎ মু’মিনদের জন্য আখিরাতে চিরস্থায়ী সুখ আর নি’আমাত আল্লাহ নির্ধারণ করে রেখেছেন।
(মিরক্বাতুল মাফাতীহ; ইবনু মাজাহ হা, ৪১৫৩, আল লুম’আহ্ ৮ম খণ্ড, ৪৬১ পৃ.)।
(৪) আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণনা করেছেন। একদিন তিনি এমন এক সম্প্রদায়ের নিকট দিয়ে অতিক্রম করলেন যাদের সম্মুখে উপস্থিত করা হয়েছিল ভুনা করা বকরী। তারা খাওয়ার জন্য আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ)-কে ডাকলেন; কিন্তু তিনি এ বলে খেতে অস্বীকার করলেন যে, নাবী (সা.) এই দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন, অথচ তিনি যবের রুটি দ্বারাও পরিতৃপ্ত হতে পারেননি। (বুখারী হা/ ৫৪১৪, মিশকাত হা/৫২৩৮)।
আবু হুরায়রাহ্ (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর জীবদ্দশায় খানা-খাদ্যের চিত্র স্মরণ করে মজাদার লোভনীয় ভুনা বকরির গোশত খাওয়ার আহ্বান পেয়েও তা বর্জন করেছেন। এটা ছিল তাঁর নাবী প্রেমের চরম নিদর্শন এবং দুনিয়াবিমুখ জীবনের অন্যতম প্রমাণ।
(মিরকাতুল মাফাতীহ; ফাতহুল বারী হা. ৫৪১৪, আল কাশিফ ১০ম খণ্ড, ৩৩১১ পৃষ্টা)