দরসে হাদীস : স্বজ্ঞানে, একাগ্রতা ও একনিষ্ঠতার সাথে ঈমান রাখুন! (পর্ব-১)

জান্নাতে তারাই যাবে, যারা স্বজ্ঞানে, একাগ্রতা ও একনিষ্ঠতার সাথে ঈমান রাখে এবং সৎ আমলের প্রতিযোগীতা করে ও হারাম থেকে নিজেকে গুটিয়ে রাখে। ’উবাদাহ্ ইবনুস্ সামিত (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে লোক (অন্তরের সাথে) এ ঘোষণা দিবে, شَهِدَ أَنْ لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَحْدَهُ لَا شَرِيكَ لَهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَسُو لُهُ أَ ’’আল্লাহ ছাড়া প্রকৃত কোন ইলাহ নেই, তাঁর কোন শরীক নেই, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর বান্দা ও তাঁরই রসূল এবং মারইয়াম (আঃ)-এর ছেলেও [’ঈসা (আঃ)] আল্লাহর বান্দা ও তাঁরই রসূল, তাঁর বান্দীর সন্তান ও আল্লাহর কালিমা, যা তিনি মারইয়াম (আঃ)-এর প্রতি প্রেরণ করেছিলেন এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত ’রূহ’, আর জান্নাত-জাহান্নাম সত্য- তার ’আমল যা-ই হোক না কেন আল্লাহ তা’আলা তাকে অবশ্যই জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। (বুখারী হা/৩৪৩৫, মুসলিম হা/২৮, মিশকাত হা/২৭)

ব্যাখ্যা:  রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বলেন, ‘যে ব্যক্তি এ সাক্ষ্য দিল যে, আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন সত্য ইলাহ নেই। তিনি একক। তাঁর কোন শরীক নেই। মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর বান্দা ও রাসূল।

এখানে বিশেষভাবে স্মরণ রাখা দরকার যে, সাক্ষ্য তখনই গ্রহণযোগ্য হওয়ার উপযুক্ত হয়, যখন তার ভিত্তি হবে ইল্ম, ইয়াকীন এবং সত্যের উপর। অজ্ঞতা এবং সন্দেহের উপর ভিত্তি করে প্রদত্ত সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য নয়। অজ্ঞতা সন্দেহের উপর ভিত্তি করে প্রদত্ত সাক্ষ্য দেয়াতে কোন উপকারও নেই। অজ্ঞতা ও সন্দেহের উপর ভিত্তি করে সাক্ষ্য দিলে সাক্ষ্যদাতা মিথ্যুক হিসাবে গণ্য হবে। কেননা সে যে বিষয়ে সাক্ষ্য দিয়েছে, সে ব্যাপারে সে সম্পূর্ণ অজ্ঞ। এই পবিত্র বাক্যটি অর্থাৎ কালেমায়ে তায়্যেবা লা-ইলাহা ইল্লাহ্-এর সাক্ষ্যটি না বাচক এবং হাঁ বাচক বক্তব্যকে শামিল করেছে। لاإله-এর মাধ্যমে আল্লাহ্ ছাড়া অন্যান্য সকল বস্ত্ত হতে ইলাহীয়াতকে নাকোচ করা হয়েছে এবং إلا الله-এর মাধ্যমে একমাত্র আল্লাহর জন্য ইলাহীয়াত সাব্যস্ত করা হয়েছে। আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ

شَهِدَ اللّهُ أَنَّهُ لاَ إِلَـهَ إِلاَّ هُوَ وَالْمَلاَئِكَةُ وَأُوْلُواْ الْعِلْمِ قَآئِمَاً بِالْقِسْطِ لاَ إِلَـهَ إِلاَّ هُوَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ

‘‘আল্লাহ্ সাক্ষ্য দিয়েছেন যে, তিনি ছাড়া অন্য কোন সত্য উপাস্য নেই। ফেরেশতাগণ এবং ন্যায়নিষ্ঠ জ্ঞানীগণও সাক্ষ্য দিয়েছেন যে, তিনি ছাড়া অন্য কোন সত্য ইলাহ্ নেই। তিনি পরাক্রমশালী প্রজ্ঞাময়’’। (সূরা আল-ইমরানঃ ১৮) অনেক লোকই কালেমা তায়্যেবার সঠিক অর্থ না জানার কারণে পথভ্রষ্ট হয়েছে। আর এই শ্রেণীর লোকের সংখ্যাই অধিক। তারা মূল অর্থকে পালটিয়ে দিয়েছে। তারা সৃষ্টির মধ্য হতে কবরবাসী, মাজারের খাদেম, তাগুত, বৃক্ষরাজি, পাথর, জিন এবং অন্যান্য সৃষ্ট বস্ত্তর জন্য উলুহীয়াত সাব্যস্ত করেছে। অথচ কালেমায়ে তায়্যেবার মধ্যে এগুলো থেকে উলুহীয়াতকে সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করা হয়েছে। তারা এগুলোর উপাসনা করাকে দ্বীন হিসাবে গ্রহণ করে নিয়েছে এবং এগুলোকে চাকচিক্যময় ও সুসজ্জিত করে প্রকাশের মাধ্যমে তাওহীদকে বিদআতে রূপান্তরিত করেছে। তারা ঐ সমস্ত তাওহীদপন্থীদের বিরুদ্ধে উঠে পড়ে লেগেছে, যারা নির্ভেজাল তাওহীদের দিকে মানুষকে আহবান করে। এই সমস্ত কবর পূজারীদের অবস্থা এই পর্যন্ত গিয়ে ঠেকেছে যে, জাহেলী যামানার কুরাইশদের অজ্ঞ কাফেররা কালেমায়ে তায়্যেবার যতটুকু অর্থ বুঝত, এই সমস্ত নামধারী মুসলিমরা এই পবিত্র বাক্যটির অর্থ ততটুকুও বুঝতে সক্ষম নয়। জাহেলী যামানার কাফেররা কালেমায়ে তাওহীদের অর্থ খুব ভাল করেই বুঝত। কিন্তু কালেমায়ে তায়্যেবা যেই ইখলাস তথা এককভাবে আল্লাহর এবাদত করার প্রতি আহবান করে, তারা কেবল তাকেই অস্বীকার করেছিল। যেমন আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ

إِنَّهُمْ كَانُوا إِذَا قِيلَ لَهُمْ لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ يَسْتَكْبِرُونَ وَيَقُولُونَ أَئِنَّا لَتَارِكُوا آلِهَتِنَا لِشَاعِرٍ مَّجْنُونٍ

‘‘তাদের যখন বলা হত, আল্লাহ্ ব্যতীত কোন সত্য উপাস্য নেই, তখন তারা অহঙ্কার করত এবং বলত, আমরা কি এক পাগল কবির কথায় আমাদের উপাস্যদেরকে পরিত্যাগ করব? (সূরা আস্ সাফ্ফাতঃ ৩৫-৩৬)

এই উম্মতের বর্তমান মুসলিম নামধারী মুশরিকরা পূর্বকালের মুশরিকদের মতই আল্লাহ্ ব্যতীত অন্যের এবাদত বর্জন করার দাওয়াতকে অস্বীকার করছে। বর্তমানে এই উম্মতের মুসলিম নামধারী মুশরিকরা আল্লাহ্কে বাদ দিয়ে মাজার, গম্বুজ, তাগুত এবং অন্যান্য বস্ত্তর পূজা শুরু করে দিয়েছে। মক্কার মুশরিকরা কালেমায়ে তায়্যেবা এবং এককভাবে আল্লাহর এবাদত করার তাৎপর্য বুঝে-শুনেই মানতে অস্বীকার করেছিল। আর এই যামানার মুসলিমগণ কালেমার অর্থ না বুঝার কারণে তার দাবী বাস্তবায়ন করতে অস্বীকার করছে। এ জন্যই আপনি দেখবেন যে, সে لاإله إلا الله বলছে। আর সেই সাথে সে আল্লাহর সাথে অন্যেরও এবাদত করছে!

আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিম (রঃ) বলেনঃ মাবুদ তিনিই হতে পারেন, লোকেরা অন্তরের একনিষ্ঠতার সাথে যার এবাদত করে, তাকে ভালবেসে, ভয়ের সাথে তাঁরই বড়ত্ব প্রকাশ করে, তাঁর দিকেই প্রত্যাবর্তন করে, তাঁকেই সম্মান করে, তাঁর সামনেই নতি স্বীকার করে, তাঁর সামনেই বিনয়ী হয়, তাঁকেই ভয় করে, তাঁর কাছেই আশা করে এবং তাঁর উপরই ভরসা করে।

উযীর আবুল মুযাফ্ফার (রঃ) তার ইফসাহনামক গ্রন্থে বলেনঃ লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্-এর সাক্ষ্য দেয়ার দাবী হচ্ছে, সাক্ষ্যদাতা এ বিষয়ে সম্পূর্ণ জ্ঞান রাখবে যে, আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কোন সত্য ইলাহ্ নেই। আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ

فَاعْلَمْ أَنَّهُ لا إِلَهَ إِلا اللَّهُ وَاسْتَغْفِرْ لِذَنْبِكَ وَلِلْمُؤْمِنِينَ وَالْمُؤْمِنَاتِ

‘‘জেনে রেখো, আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কোন সত্য মাবুদ নেই। অতঃপর ক্ষমা প্রার্থনা করো, তোমার নিজের গুনাহর জন্য এবং মুমিন পুরুষ ও নারীদের জন্য’’। (সূরা মুহাম্মাদঃ ১৯) এখানে إلا -এর পরে الله মারফু হয়েছে। এর অর্থ দাঁড়ায় আল্লাহই হচ্ছেন এবাদতের একমাত্র হকদার। আল্লাহর যাতে পাক ব্যতীত অন্য কেউ এবাদতের হকদার নন। কালেমায়ে তায়্যেবা সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত কথা হচ্ছে, এই পবিত্র বাক্যটি আল্লাহর প্রতি ঈমান আনয়নের সাথে সাথে প্রত্যেক তাগুতকে অস্বীকার করার দাবী জানায়। সুতরাং আপনি যখন আল্লাহ্ ছাড়া অন্যান্য সকল বস্ত্ত হতে উলুহীয়াতকে অস্বীকার করবেন এবং শুধু আল্লাহর জন্যই তা সাব্যস্ত করবেন, তখন আপনি সমস্ত তাগুতকে অস্বীকারকারী এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান আনয়নকারীদের অন্তর্ভূক্ত হবেন।

ইমাম ইবনে রজব (রঃ) বলেনঃ ইলাহ্ হচ্ছেন সেই সত্তা, যার আনুগত্য করা হয় এবং যার নাফরমানী করা হয়না। যাকে সম্মান করা হয়, যার বড়ত্ব প্রকাশ করা হয়, যাকে ভালোবাসা হয়, যাকে ভয় করা হয়, যার কাছে আশা করা হয়, যার উপর ভরসা করা হয়, যার কাছে চাওয়া হয় এবং যার কাছে দুআ করা হয়। এসব বস্ত্ত মহান আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কারো জন্য সাব্যস্ত করা শোভনীয় নয়। যে ব্যক্তি উলুহীয়াতের এ সমস্ত বৈশিষ্ট্যে কোন মাখলুককে আল্লাহর সাথে শরীক করল, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্ বলার ক্ষেত্রে তার ইখলাস ত্রুটিপূর্ণ হবে এবং তার মধ্যে সেই ত্রুটি অনুযায়ী মাখলুকের উবুদীয়াত পাওয়া যাবে।

ইমাম বিকাঈ (রঃ) বলেনঃ لاإله إلا الله -এই পবিত্র বাক্যটি মহান বাদশাহ আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কোন সত্য মাবুদ থাকার কথাকে দৃঢ়তার সাথে অস্বীকার করেছে। এই বিশ্বাসই কিয়ামতের ভয়াবহ আযাব থেকে নাজাতের সর্বোত্তম মাধ্যম। কালেমার এই জ্ঞানটি তখনই প্রকৃত জ্ঞান বলে বিবেচিত হবে, যখন তা উপকারী হবে। আর তা উপকারী তখনই হবে, যখন তা অন্তর থেকে পাঠ করা হবে এবং তার দাবী অনুযায়ী আমল করা হবে। অন্যথায় তা নিছক মূর্খতা বলেই গণ্য হবে।

এই উম্মতের পরবর্তী যামানার লোকেরা لاإله إلا الله -এর অর্থ সম্পর্কে অজ্ঞ। এর সঠিক অর্থকে রুবুবীয়াতের অর্থের মাধ্যমে বদল করে ফেলেছে। অর্থাৎ তারা আল্লাহর জন্য শুধু সৃষ্টি করা ও প্রতিপালন করার ক্ষমতা সাব্যস্ত করছে। এর মাধ্যমে তারা লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্ যেই শির্ক থেকে নিষেধ করেছে, তারা আল্লাহর জন্য তাই সাব্যস্ত করেছে। তারা মূর্খতা বশতঃ কালেমা তায়্যেবা ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ আল্লাহর জন্য যেই এবাদতকে খালেস করতে বলেছে, তা করতে অস্বীকার করেছে। সূরা যুমারের ২ নং আয়াতে আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃفَاعْبُدِ اللَّهَ مُخْلِصاً لَّهُ الدِّينَ ‘‘তুমি আল্লাহর এবাদত কর, দ্বীনকে তাঁর জন্য খালেস করে’’।

ইমাম নববী (রঃ) বলেনঃ দীর্ঘ দিন যাবৎ আমর বিল মারুফ এবং নাহী আনিল মুনকার তথা সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধের দরজা বন্ধ রয়েছে। বর্তমান সময়ে খুব সীমিত আকারে কেবল এর নামটি বিদ্যমান রয়েছে। অথচ এটি ইসলামের বিরাট একটি স্তম্ভ। এর মাধ্যমেই কল্যাণের পথ প্রসারিত এবং স্থায়ী হয়। আর এর অবর্তমানে অন্যায় ও অকল্যাণের পথ প্রশস্ত হয়। পৃথিবীতে যখন পাপকাজ ছড়িয়ে পড়ে তখন আল্লাহর শাস্তি ভাল ও খারাপ সকল শ্রেণীর লোককেই পাকড়াও করে। কেউ এ থেকে রেহাই পায়না। ইমাম নববী (রঃ) বর্তমান সময় বলতে হিজরী পঞ্চম এবং ষষ্ঠ শতক উদ্দেশ্য করেছেন। পঞ্চম ও ষষ্ঠ হিজরী সালের অবস্থা যদি এই হয়, তাহলে দশম ও তার পরবর্তী শতকের অবস্থা কেমন ভয়াবহ হতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়। পরবর্তী শতাব্দীগুলোতে ইসলামের দুর্বলতা প্রকট আকার ধারণ করেছে তথা সঠিক ইসলাম একেবারেই অপরিচিত হয়ে গেছে। আমাদের শাইখ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাব (রঃ) গুরবাতুল ইসলামের এক সুন্দর ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তাঁর মত সুন্দর ও অভিনব ব্যাখ্যা ইতিপূর্বে অন্য কেউ প্রদান করেনি। শাইখের ব্যাখ্যাটি পাঠ করা অত্যন্ত জরুরী। কেননা এই ব্যাখ্যাটি জানার বিশেষ প্রয়োজন রয়েছে।[6]

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণীঃ وحده لا شريك له ‘‘তিনি একক, তাঁর কোন শরীক নেই’’-এই বাক্যটি لاإله إلا الله এর অর্থকে শক্তিশালী করছে এবং এর প্রকৃত তাৎপর্যকেই ব্যাখ্যা করছে। মূলতঃ এটিও তাওহীদের প্রমাণ বহন করে। সুতরাং لاإله কথাটি এবাদতের মধ্যে সামান্যতম শির্ক করাকেও প্রত্যাখ্যান করেছে। لاشريك له কথাটি সেই অর্থকেই সুস্পষ্ট ও ব্যাখ্যা করেছে। অর্থাৎ এবাদতে আল্লাহর কোন শরীক নেই। وحده এর মধ্যে إلا الله এর অর্থ বিদ্যমান। সুতরাং আল্লাহই একমাত্র সত্য ইলাহ। তিনি ব্যতীত আসমান-যমীনের কেউ কোন প্রকার এবাদতের হকদার নয়। কুরআনের মুহকাম আয়াতগুলো এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মুতাওয়াতের হাদীছগুলো এ কথারই প্রমাণ বহন করে। আপনি যখন এই ব্যাখ্যাকে মনোযোগ দিয়ে পড়বেন, তখন আপনার কাছে ঐ সমস্ত লোকদের কথা বাতিল বলে প্রমাণিত হবে, যারা বলে আল্লাহ্ ছাড়া অন্যের কাছে দুআ করা জায়েয। আল্লাহ্ তাআলা তাঁর নবীকে বলেনঃ

فَلَا تَدْعُ مَعَ اللَّهِ إِلَهاً آخَرَ فَتَكُونَ مِنَ الْمُعَذَّبِينَ

‘‘অতএব, তুমি আল্লাহ্‌র সাথে অন্য উপাস্যকে আহবান করবেনা। করলে শাস্তিতে পতিত হবে’’। (সূরা শুআরাঃ ২১৩) এ রকম আরো অনেক আয়াত রয়েছে। অচিরেই এর বিস্তারিত আলোচনা আসবে, ইনশা-আল্লাহ্ । সুতরাং وحده لا شريك له এর মধ্যে وحده শব্দটি হাঁ বাচক বিষয়কে জোরদার করছে আর لا شريك له বাক্যটি না বাচক বিষয়কে জোরদার করছে।

হাদীছের অংশ وأن محمدا عبده ورسوله -এর অর্থ হচ্ছে অন্তর থেকে বিশ্বাস ও সত্যায়ন করবে যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর বান্দা ও রাসূল। এ কথার দাবী হচ্ছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুসরণ করা হবে, তাঁর আদেশ ও নিষেধের প্রতি সম্মান করা হবে এবং তাঁর সুন্নাতের উপর আমল করা হবে। কোন মানুষের কথা দ্বারা তাঁর সুন্নাতের বিরোধীতা করা যাবেনা। কেননা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ব্যতীত অন্য কারো কথা ভুলের উর্ধ্বে নয়। আল্লাহ্ তাআলা তাঁকে ভুল থেকে হেফাজত করেছেন। আল্লাহ্ তাআলা আমাদেরকে তাঁর আনুগত্য করার এবং তাঁকে আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করার আদেশ দিয়েছেন। নিম্নের আয়াতে তাঁর আনুগত্য বর্জনকারীদের শাস্তির কথা বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ

فَلا وَرَبِّكَ لا يُؤْمِنُونَ حَتَّى يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ لا يَجِدُوا فِي أَنْفُسِهِمْ حَرَجاً مِمَّا قَضَيْتَ وَيُسَلِّمُوا تَسْلِيماً

‘‘অতএব, তোমার পালনকর্তার কসম, সে পর্যন্ত তারা ঈমানদার হবেনা, যতক্ষণ না তাদের মধ্যে সৃষ্ট বিবাদের ব্যাপারে তোমাকে ন্যায়বিচারক বলে মেনে নেয়। অতঃপর তোমার মীমাংসার ব্যাপারে নিজেদের মনে কোন সংকীর্ণতা পাবেনা এবং তা সন্তুষ্ট চিত্তে কবুল করে নেবে’’। (সূরা নিসাঃ ৬৫) আল্লাহ্ তাআলা আরো বলেনঃ

فَلْيَحْذَرْ الَّذِينَ يُخَالِفُونَ عَنْ أَمْرِهِ أَنْ تُصِيبَهُمْ فِتْنَةٌ أَوْ يُصِيبَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ

‘‘অতএব, যারা তাঁর নবীর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আদেশের বিরুদ্ধাচরণ করে, তারা এ বিষয়ে সতর্ক হোক যে, ফিত্না তাদেরকে গ্রাস করবে অথবা যন্ত্রনাদায়ক শাস্তি তাদেরকে আক্রমণ করবে।’’ (সূরা নূরঃ ৬৩) ইমাম আহমাদ বিন হাম্বাল (রঃ) বলেনঃ আমি ঐ সমস্ত লোকের জন্য আশ্চর্যবোধ করি, যারা হাদীছের সনদ ও তার সত্যতা জানার পরও সুফীয়ানের রায় গ্রহণ করে। অথচ আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ

فَلْيَحْذَرْ الَّذِينَ يُخَالِفُونَ عَنْ أَمْرِهِ أَنْ تُصِيبَهُمْ فِتْنَةٌ أَوْ يُصِيبَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ

‘‘অতএব, যারা তাঁর নবীর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আদেশের বিরুদ্ধাচরণ করে, তারা এ বিষয়ে সতর্ক হোক যে, ফিত্না তাদেরকে গ্রাস করবে অথবা যন্ত্রনাদায়ক শাস্তি তাদেরকে আক্রমণ করবে’’। তুমি কি জান ফিতনা কাকে বলে? ফিতনাহ্ হচ্ছে শির্ক। কোন মানুষ যখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কোন কথা প্রত্যাখ্যান করবে, তখন এমন আশঙ্কা রয়েছে যে, তার অন্তরে বক্রতা প্রবেশ করবে। পরিণামে সে ধ্বংস হবে। বর্তমানে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাতের অনুসরণ করার ক্ষেত্রে যথেষ্ট ত্রুটি করা হচ্ছে। তা বর্জনও করা হচ্ছে। তাঁর সুন্নাত ও কথার উপর ঐ সমস্ত লোকদের কথাকে প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে, যাদের কথার মধ্যে ভুল হওয়া খুবই স্বাভাবিক। বিশেষ করে আলেমরা এই রোগে আক্রান্ত হয়েছে। এ বিষয়টি বর্তমানে সকলের নিকট সুস্পষ্ট।

ঈসা আলাইহিস সালাম আল্লাহর বান্দা ও রাসূলঃ এ কথার সাক্ষ্য দেয়ার মধ্যে ঐ মহা সত্যটি তুলে ধরা হয়েছে, যা বিশ্বাস করা ফরয। কুরআনের মুহকাম আয়াতসমূহ দ্বারা বিষয়টি প্রমাণিত। তাতে কাফের খৃষ্টানদের প্রতিবাদও রয়েছে। এরা তিনটি দলে বিভক্ত। এক দলের কথা হচ্ছে, ঈসা (আঃ)-ই আল্লাহ্। অন্য দল বলছে, তিনি আল্লাহর পুত্র। আরেক দলের মত হচ্ছে, আল্লাহ্ তিনজনের একজন। অর্থাৎ ঈসা, তাঁর মা মারইয়াম এবং তৃতীয় হচ্ছেন আল্লাহ।

আল্লাহ্ তাআলা কুরআন মজীদে এ বিষয়ে মূল সত্যটি বর্ণনা করেছেন এবং বাতিলের প্রতিবাদ করেছেন। আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ

يَا أَهْلَ الْكِتَابِ لاَ تَغْلُواْ فِي دِينِكُمْ وَلاَ تَقُولُواْ عَلَى اللّهِ إِلاَّ الْحَقِّ إِنَّمَا الْمَسِيحُ عِيسَى ابْنُ مَرْيَمَ رَسُولُ اللّهِ وَكَلِمَتُهُ أَلْقَاهَا إِلَى مَرْيَمَ وَرُوحٌ مِّنْهُ فَآمِنُواْ بِاللّهِ وَرُسُلِهِ وَلاَ تَقُولُواْ ثَلاَثَةٌ انتَهُواْ خَيْراً لَّكُمْ إِنَّمَا اللّهُ إِلَـهٌ وَاحِدٌ سُبْحَانَهُ أَن يَكُونَ لَهُ وَلَدٌ لَّهُ مَا فِي السَّمَاوَات وَمَا فِي الأَرْضِ وَكَفَى بِاللّهِ وَكِيلاً لَنْ يَسْتَنْكِفَ الْمَسِيحُ أَنْ يَكُونَ عَبْدًا لِلَّهِ وَلا الْمَلائِكَةُ الْمُقَرَّبُونَ وَمَنْ يَسْتَنْكِفْ عَنْ عِبَادَتِهِ وَيَسْتَكْبِرْ فَسَيَحْشُرُهُمْ إِلَيْهِ جَمِيعًا

‘‘হে আহলে-কিতাবগণ! তোমরা দ্বীনের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করোনা এবং আল্লাহ্‌র শানে নিতান্ত সঙ্গত বিষয় ছাড়া কোন কথা বলোনা। নিঃসন্দেহে মরিয়ম পুত্র মসীহ ঈসা আল্লাহ্‌র রাসূল এবং তার বাণী, যা তিনি প্রেরণ করেছেন মরিয়মের নিকট এবং তারই কাছ থেকে আগত একটি রূহ। অতএব, তোমরা আল্লাহ্কে এবং তার রাসূলগণকে মান্য করো। আর এ কথা বলোনা যে, আল্লাহ্ তিনের এক, এ কথা পরিহার করো; তোমাদের মঙ্গল হবে। নিঃসন্দেহে আল্লাহ্ একক উপাস্য। সন্তান-সন্ততি হওয়া তাঁর যোগ্য বিষয় নয়। যা কিছু আসমানসমূহ ও যমীনে রয়েছে সবই তাঁর। আর কর্ম সম্পাদনে আল্লাহ্ই যথেষ্ট। মসীহ্ আল্লাহ্‌র বান্দা হবেন, তাতে তার কোন লজ্জাবোধ নেই এবং ঘনিষ্ঠ ফেরেশতাদেরও না। বস্ত্ততঃ যারা আল্লাহ্‌র এবাদত করতে লজ্জাবোধ করবে এবং অহংকার করবে, তিনি তাদের সবাইকে নিজের কাছে সমবেত করবেন’’। (সূরা নিসাঃ ১৭১-১৭২) আল্লাহ্ তাআলা আরো বলেনঃ

لَقَدْ كَفَرَ الَّذِينَ قَالُوا إِنَّ اللَّهَ هُوَ الْمَسِيحُ ابْنُ مَرْيَمَ قُلْ فَمَنْ يَمْلِكُ مِنَ اللَّهِ شَيْئًا إِنْ أَرَادَ أَنْ يُهْلِكَ الْمَسِيحَ ابْنَ مَرْيَمَ وَأُمَّهُ وَمَنْ فِي الأرْضِ جَمِيعًا وَلِلَّهِ مُلْكُ السَّمَاوَاتِ وَالأرْضِ وَمَا بَيْنَهُمَا يخْلُقُ مَا يَشَاءُ وَاللَّهُ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ

‘‘নিশ্চয়ই তারা কাফের, যারা বলে মসীহ্ ইবনে মরিয়মই আল্লাহ্। তুমি জিজ্ঞাসা করো, তবে আল্লাহ্ যদি মসীহ্ ইবনে মারইয়াম, তার মা এবং ভূমন্ডলে যারা আছে অচিরেই তাদের সবাইকে ধ্বংস করতে চান, তাহলে এমন কারো সাধ্য আছে কি যে আল্লাহ্‌র কাছ থেকে তাদেরকে বিন্দুমাত্রও বাঁচাতে পারে? নভোমন্ডল, ভূমন্ডল ও এতদুভয়ের মধ্যে যা আছে, সবকিছুর উপর আল্লাহ্‌রই আধিপত্য। তিনি যা ইচ্ছা সৃষ্টি করেন। আল্লাহ্ সবকিছুর উপর শক্তিমান’’। (সূরা মায়িদাঃ ১৭)[8] সূরা মায়িদার একাধিক স্থানে এ বিষয়ে বিশদ বর্ণনা এসেছে। এ সমস্ত স্থানে আল্লাহ্ তাআলা ঐ কথা বলে দিয়েছেন, যা ঈসা (আঃ) জন্মের পর মায়ের কোলে থাকা অবস্থায় ব্যক্ত করেছিলেন। সূরা মারইয়ামের ২৭ থেকে ৩৬ নং আয়াতে আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ

فَأَتَتْ بِهِ قَوْمَهَا تَحْمِلُهُ قَالُوا يَا مَرْيَمُ لَقَدْ جِئْتِ شَيْئاً فَرِيّاً يَا أُخْتَ هَارُونَ مَا كَانَ أَبُوكِ امْرَأَ سَوْءٍ وَمَا كَانَتْ أُمُّكِ بَغِيّاً فَأَشَارَتْ إِلَيْهِ قَالُوا كَيْفَ نُكَلِّمُ مَن كَانَ فِي الْمَهْدِ صَبِيّاً قَالَ إِنِّي عَبْدُ اللَّهِ آتَانِيَ الْكِتَابَ وَجَعَلَنِي نَبِيّاً وَجَعَلَنِي مُبَارَكاً أَيْنَ مَا كُنتُ وَأَوْصَانِي بِالصَّلَاةِ وَالزَّكَاةِ مَا دُمْتُ حَيّاً وَبَرّاً بِوَالِدَتِي وَلَمْ يَجْعَلْنِي جَبَّاراً شَقِيّاً وَالسَّلَامُ عَلَيَّ يَوْمَ وُلِدتُّ وَيَوْمَ أَمُوتُ وَيَوْمَ أُبْعَثُ حَيّاً ذَلِكَ عِيسَى ابْنُ مَرْيَمَ قَوْلَ الْحَقِّ الَّذِي فِيهِ يَمْتَرُونَ مَا كَانَ لِلَّهِ أَن يَتَّخِذَ مِن وَلَدٍ سُبْحَانَهُ إِذَا قَضَى أَمْراً فَإِنَّمَا يَقُولُ لَهُ كُن فَيَكُونُ وَإِنَّ اللَّهَ رَبِّي وَرَبُّكُمْ فَاعْبُدُوهُ هَذَا صِرَاطٌ مُّسْتَقِيمٌ

‘‘অতঃপর তিনি সন্তানকে নিয়ে তার সম্প্রদায়ের কাছে উপস্থিত হলেন। তারা বললঃ হে মারইয়াম, তুমি একটি অঘটন ঘটিয়ে বসেছ। হে হারুনের বোন! তোমার পিতা অসৎ ব্যক্তি ছিলেন না এবং তোমার মাতাও ব্যভিচারিনী ছিলেন না। অতঃপর তিনি হাত দ্বারা সন্তানের দিকে ইঙ্গিত করলেন। তারা বললঃ কোলের শিশুর সাথে আমরা কেমন করে কথা বলবো? সন্তান বললঃ আমি তো আল্লাহ্‌র বান্দা। তিনি আমাকে কিতাব দিয়েছেন এবং আমাকে নবী করেছেন। আমি যেখানেই থাকি, তিনি আমাকে বরকতময় করেছেন। তিনি আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন, যতদিন জীবিত থাকি ততদিন নামায ও যাকাত আদায় করতে। আর আমি জননীর অনুগত হবো। আমাকে তিনি অহংকারী ও হতভাগ্য করেন নি। আমার প্রতি শান্তি যেদিন আমি জন্মগ্রহণ করেছি, যেদিন মৃত্যুবরণ করবো এবং যেদিন আমাকে জীবিত করে উঠানো হবে। ইনি হচ্ছেন মারইয়ামের পুত্র ঈসা এবং এ হচ্ছে তার সম্পর্কে সত্য কথা, যে সম্পর্কে লোকেরা সন্দেহ করছে। কাউকে সন্তান হিসাবে গ্রহণ করা আল্লাহর জন্য শোভনীয় নয়, তিনি পবিত্র সত্তা। তিনি যখন কোন কাজ করার সিদ্ধান্ত নেন, তখন এ কথাই বলেনঃ হয়ে যাও, অমনি তা হয়ে যায়। আর ঈসা বলেছিলঃ নিশ্চয়ই আল্লাহ্ আমার প্রতিপালক তোমাদের প্রতিপালক। অতএব, তোমরা তাঁর এবাদত করো। এটাই সরল পথ’’। এখানে আল্লাহ্ তাআলা ঐ সঠিক পথের আলোচনা করেছেন, যে পথের অনুসারীরা নাজাতের হকদার হবে। আর যে ব্যক্তি ঐ পথের বাইরে চলবে, সে ধ্বংস হবে। আল্লাহ্ তাআলা সূরা আল-ইমরানের ৫৯-৬০ নং আয়াতে বলেনঃ

إِنَّ مَثَلَ عِيسَى عِندَ اللّهِ كَمَثَلِ آدَمَ خَلَقَهُ مِن تُرَابٍ ثِمَّ قَالَ لَهُ كُن فَيَكُونُ الْحَقُّ مِن رَّبِّكَ فَلاَ تَكُن مِّن الْمُمْتَرِينَ

‘‘নিঃসন্দেহে আল্লাহ্‌র নিকট ঈসার দৃষ্টান্ত হচ্ছে আদমেরই মত। তাকে মাটি দিয়ে তৈরি করেছেন তারপর তাকে বলেছিলেনঃ হয়ে যাও, সঙ্গে সঙ্গে হয়ে গেল। যা তোমার প্রতিপালক বলেন তাই যথার্থ সত্য। কাজেই তোমরা সংশয়বাদী হয়োনা’’। আল্লাহ্ তাআলা সীরাতুল মুস্তাকীমকে সুস্পষ্ট ও পরিপূর্ণরূপে বর্ণনা করেছেন এবং তাঁর তাওহীদের দলীল-প্রমাণসমূহ বর্ণনা করেছেন। মুশরিকদের অপছন্দ সত্ত্বেও তিনি সত্যকে প্রমাণিত ও প্রতিষ্ঠিত করেছেন এবং মিথ্যাকে বাতিল করেছেন।

ঈসা আলাইহিস সালাম আল্লাহর এমন এক কালিমা, যা তিনি মরিয়ামের প্রতি প্রেরণ করেছেনঃ এখানে কালিমার অর্থ হচ্ছে তাঁর বাণী كُنْ হয়ে যাও। সুতরাং আল্লাহ্ তাআলা ঈসা (আঃ)কে তাঁর কালিমা كُنْ দ্বারা সৃষ্টি করেছেন। এর দ্বারা আরো প্রমাণিত হল যে, আল্লাহ্ তাআলা কথা বলেন, কথা বলা তাঁর অন্যতম একটি সিফাত। কিন্তু জাহমীয়ারা এতে বিশ্বাস করেনা।

ঈসা (আঃ) আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত রূহঃ এ কথার সাক্ষ্য দেয়ার অর্থ হচ্ছে, তিনি ঐ সমস্ত রূহের অন্তর্ভূক্ত, যাদেরকে আল্লাহ্ তাআলা আদম (আঃ)এর পৃষ্ঠদেশ থেকে নির্গত করেছেন এবং তাদের থেকে এই মর্মে অঙ্গীকার নিয়েছেন যে, আল্লাহ্ তাআলাই হচ্ছেন তাদের প্রভু ও মাবুদ। আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ

وَإِذْ أَخَذَ رَبُّكَ مِن بَنِي آدَمَ مِن ظُهُورِهِمْ ذُرِّيَّتَهُمْ وَأَشْهَدَهُمْ عَلَى أَنفُسِهِمْ أَلَسْتُ بِرَبِّكُمْ قَالُواْ بَلَى شَهِدْنَا أَنْ تَقُولُوا يَوْمَ الْقِيَامَةِ إِنَّا كُنَّا عَنْ هَذَا غَافِلِينَ

‘‘আর যখন তোমার প্রতিপালক বনী আদমের পৃষ্টদেশ থেকে বের করলেন তাদের সন্তানদেরকে এবং তাদেরকে তাদের নিজেদের উপর সাক্ষী রেখে প্রতিজ্ঞা করালেন, আমি কি তোমাদের প্রতিপালক নই? তারা বলল, অবশ্যই, আমরা অঙ্গীকার করছি। আবার না কিয়ামতের দিন বলতে শুরু কর যে, এ বিষয়টি আমাদের জানা ছিলনা’’। (সূরা আরাফঃ ১৭২) সুতরাং ঈসা (আঃ)এর রূহ ঐ সমস্ত রূহের অন্তর্ভূক্ত, যা তিনি সৃষ্টি করেছেন।

ইবনে জারীর (রঃ) সূরা মারইয়ামের ২২ নং আয়াতের ব্যাখ্যায় ওয়াহাব বিন মুনাবিবহ (রঃ)এর বরাত দিয়ে বলেনঃ জিবরীল মারিয়ামের কোর্তার পকেটে ফুঁ দিলেন। ফুঁ-এর প্রভাব মারইয়ামের জরায়ু পর্যন্ত পৌঁছে গেল। এতে তিনি গর্ভবতী হয়ে গেলেন। ইমাম সুদ্দী (রঃ) বলেনঃ ফুৎকারের প্রভাব মারইয়ামের বক্ষদেশে প্রবেশ করল। এতেই তিনি ঈসা (আঃ)কে পেটে ধারণ করলেন। ইবনে জুরাইয (রঃ) বলেনঃ বলা হয় যে, জিবরীল (আঃ) মারইয়ামের কোর্তার গলদ্বারে ও আস্তীনে ফুঁ দিয়েছেন।

সার কথা হচ্ছে, জিবরীল ফুঁ দিয়েছেন আর আল্লাহ্ তাআলা তাঁর كٌنْ বাক্য দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর ঈসা (আঃ) সৃষ্টি হয়ে গেছেন। আল্লাহ্ তাআলা সূরা হিজরে আদম (আঃ)-এর ব্যাপারে বলেনঃ

وَإِذْ قَالَ رَبُّكَ لِلْمَلائِكَةِ إِنِّي خَالِقٌ بَشَرًا مِنْ صَلْصَالٍ مِنْ حَمَإٍ مَسْنُونٍ فَإِذَا سَوَّيْتُهُ وَنَفَخْتُ فِيهِ مِنْ رُوحِي فَقَعُوا لَهُ سَاجِدِينَ فَسَجَدَ الْمَلائِكَةُ كُلُّهُمْ أَجْمَعُونَ إِلا إِبْلِيسَ أَبَى أَنْ يَكُونَ مَعَ السَّاجِدِيْنَ

‘‘আর তোমার প্রভু যখন ফেরেশতাদেরকে বললেনঃ আমি পচা কর্দম থেকে তৈরি বিশুষ্ক ঠনঠনে মাটি দ্বারা সৃষ্ট একটি মানব জাতির পত্তন করব। অতঃপর যখন তাকে ঠিকঠাক করে নেব এবং তাতে আমার রূহ থেকে ফুঁ দেব, তখন তোমরা তার সামনে সেজদায় পরে যেয়ো। তখন ফেরেশতারা সবাই মিলে সেজদা করল। কিন্তু ইবলীস ব্যতীত। সে সেজদাকারীদের অন্তর্ভুক্ত হতে অস্বীকৃতি জানালো। (সূরা হিজরঃ ২৮-৩১) সেই সত্তা অতি পবিত্র, যিনি ব্যতীত অন্য কোন সৃষ্টি কর্তা নেই। তিনি ব্যতীত অন্য কেউ এবাদতের যোগ্যও নয়।

কতিপয় খৃষ্টান মুসলমানদের কতক আলেমের সাথে আল্লাহর বাণীঃ وَرُوحٌ مِّنْهُ অর্থাৎ ঈসা (আঃ) আল্লাহর রূহ, -এ কথার মাধ্যমে দলীল পেশ করে তর্ক শুরু করল। তারা বলতে চাইল যে, ঈসা (আঃ) আল্লাহর রূহ তথা আল্লাহর অংশ বা তিনিই আল্লাহ্। তখন মুসলিম আলেমগণ তাদের উত্তরে বললেনঃ এটি শুধু ঈসা (আঃ)এর জন্য খাস নয়; বরং ঈসা (আঃ) এর মতই সকল সৃষ্টি আল্লাহর এবং আল্লাহর পক্ষ হতে। যেমন আল্লাহ্ তাআলা সূরা জাসিয়ার ১৩ নং আয়াতে বলেনঃ

وَسَخَّرَ لَكُمْ مَا فِي السَّمَوَاتِ وَمَا فِي الأرْضِ جَمِيعًا مِنْهُ إِنَّ فِي ذَلِكَ لآيَاتٍ لِقَوْمٍ يَتَفَكَّرُونَ

‘‘এবং তিনি আসমান ও যমীনের সমস্ত জিনিষকেই তোমাদের অনুগত করে দিয়েছেন। সবকিছুই তাঁর পক্ষ থেকে। নিশ্চয়ই এতে চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্যে নিদর্শনাবলী রয়েছে’’। (সূরা জাসিয়াঃ ১৩) অর্থাৎ আসমান-যমীনের সব কিছুর সৃষ্টি কর্তা একমাত্র তিনি। তার মধ্যে ঈসা (আঃ)ও শামিল। অন্যান্য সকল বস্ত্তর ন্যায় তিনি ঈসাকেও সৃষ্টি করেছেন’’।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

loader-image

Scroll to Top