১. প্রথম মানব-মানবী সৃষ্টির আদি কথা : প্রথম মানব-মানবী হ’লেন হযরত আদম ও হাওয়া (আঃ)। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা এই ধরণীতে মাটি থেকে একজন প্রতিনিধি সৃষ্টি করেন এবং তারপর তা থেকে ক্রমশঃ সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে এই মানব জাতি। মহান আল্লাহর ভাষায়, يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّا خَلَقْنَاكُمْ مِنْ ذَكَرٍ وَأُنْثَى وَجَعَلْنَاكُمْ شُعُوْبًا وَقَبَائِلَ لِتَعَارَفُوْا ‘হে মানবমন্ডলী! আমরা তোমাদেরকে এক পুরুষ ও এক নারী থেকে সৃষ্টি করেছি। আর তোমাদেরকে বিভিন্ন বংশ ও গোত্রে বিভক্ত করেছি, যেন তোমরা পরস্পরে পরিচিতি লাভ করতে পার’ (হুজুরাত ৪৯/১৩)।
আদি মানব কি বস্ত্ত থেকে সৃষ্টি তা মহাগ্রন্থ আল-কুরআনে মহান আল্লাহ্ স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করেছেন যে, ‘কাদামাটি থেকে মানব সৃষ্টির সূচনা (সাজদাহ ৩২/৭), আমি মানবকে পঁচা কাদা থেকে তৈরী বিশুষ্ক ঠনঠনে মাটি (হিজর ১৫/২৬), এঁটেল মাটি (ছাফ্ফাত ৩৭/১১), পোড়া মাটির ন্যায় শুষ্ক মাটি থেকে সৃষ্টি করেছি’ (আর-রহমান ৫৫/১৪)।আল্লাহ তাকে নিজ হাতে সৃষ্টি করেছেন (ছোয়াদ ৩৮/৭৫) এবং তার মধ্যে রূহ ফুঁকে দিয়েছেন (ছোয়াদ ৩৮/৭২) আদম একাই শুধুমাত্র মাটি থেকে সৃষ্টি। বাকী সবাই পিতা-মাতার মাধ্যমে সৃষ্ট’ (সাজদাহ ৩২/৭-৯)।
হযরত আদম (আঃ) মাটির সারাংশ থেকে সৃষ্টি। কিন্তু মা হাওয়া (আঃ) কি দিয়ে সৃষ্টি সে সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, ‘অতঃপর তিনি তার (আদম) থেকে তার যুগল (হাওয়াকে) সৃষ্টি করেছেন’ (যুমার ৩৯/৬)। তিনি আরও বলেন, ‘তিনি তার (আদম) থেকে তার সঙ্গিনীকে সৃষ্টি করেছেন। আর বিস্তার করেছেন তাদের দু’জন থেকে অগণিত নারী-পুরুষ’ (নিসা ৪/১)। অন্যত্র বলেন, ‘তোমাদের মধ্য থেকে তোমাদের সঙ্গিনীকে, তোমাদের জন্যই সৃষ্টি করেছেন’ (রূম ৩০/২১)।
মহান আল্লাহ হযরত আদম (আঃ)-এর পাঁজরের বাঁকা হাড় থেকে মা হাওয়াকে সৃষ্টি করেছেন। আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেন, فَإِنَّ الْمَرْأَةَ خُلِقَتْ مِنْ ضِلَعٍ، وَإِنَّ أَعْوَجَ شَىْءٍ فِى الضِّلَعِ أَعْلاَهُ، فَإِنْ ذَهَبْتَ تُقِيْمُهُ كَسَرْتَهُ، وَإِنْ تَرَكْتَهُ لَمْ يَزَلْ أَعْوَجَ، فَاسْتَوْصُوْا بِالنِّسَاءِ. ‘নারী জাতিকে পাঁজরের বাঁকা হাড় দ্বারা সৃষ্টি করা হয়েছে। আর পাঁজরের হাড়ের মধ্যে একেবারে উপরের হাড়টি অধিক বাঁকা। যদি তা সোজা করতে যাও, ভেঙ্গে ফেলবে। আর যদি তা ছেড়ে দাও, তবে সব সময় বাঁকাই থাকবে। সুতরাং তোমরা নারীদের সাথে উত্তম ও উপদেশমূলক কথাবার্তা বলবে’।[4]
পৃথিবীতে প্রথম মানব আদম (আঃ) মাটি থেকে এবং প্রথম মানবী হাওয়া (আঃ) আদমের পাঁজরের বাঁকা হাড় থেকে সৃষ্টি। এতদ্ব্যতীত সকল মানব-মানবী এক ফোঁটা অপবিত্র তরল পদার্থ (বীর্য) থেকে অদ্যাবধি সৃষ্টি হয়ে চলেছে। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ্ বলেন,فَإِنَّا خَلَقْنَاكُمْ مِنْ تُرَابٍ ثُمَّ مِنْ نُطْفَةٍ ثُمَّ مِنْ عَلَقَةٍ ثُمَّ مِنْ مُضْغَةٍ مُخَلَّقَةٍ وَغَيْرِ مُخَلَّقَةٍ لِنُبَيِّنَ لَكُمْ وَنُقِرُّ فِي الْأَرْحَامِ مَا نَشَاءُ إِلَى أَجَلٍ مُسَمًّى ثُمَّ نُخْرِجُكُمْ طِفْلاً. ‘অতঃপর আমরা তোমাদেরকে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছি। এরপর বীর্য থেকে, জমাট বাঁধা রক্ত থেকে, এরপর পূর্ণ আকৃতি ও অপূর্ণ আকৃতি বিশিষ্ট গোশতপিন্ড থেকে, তোমাদের কাছে ব্যক্ত করার জন্যে। আর আমরা নির্দিষ্ট কালের জন্য মাতৃগর্ভে যা ইচ্ছা রেখে দেই, এরপর শিশু অবস্থায় বের করি’ (হজ্জ ২২/৫)। রাসূলুলল্লাহ (ছাঃ) মাতৃগর্ভে মানব শিশু জন্মের সন্তান সম্পর্কে এভাবে বলেছেন,
إِنَّ أَحَدَكُمْ يُجْمَعُ خَلْقُهُ فِىْ بَطْنِ أُمِّهِ أَرْبَعِيْنَ يَوْمًا، ثُمَّ يَكُوْنُ عَلَقَةً مِثْلَ ذَلِكَ، ثُمَّ يَكُوْنُ مُضْغَةً مِثْلَ ذَلِكَ، ثُمَّ يَبْعَثُ اللهُ مَلَكًا، فَيُؤْمَرُ بِأَرْبَعِ كَلِمَاتٍ، وَيُقَالُ لَهُ اكْتُبْ عَمَلَهُ وَرِزْقَهُ وَأَجَلَهُ وَشَقِىٌّ أَوْ سَعِيْدٌ ثُمَّ يُنْفَخُ فِيْهِ الرُّوْحُ.
‘তোমাদের প্রত্যেকের সৃষ্টির উপাদান আপন মাতৃগর্ভে বীর্যের আকারে ৪০ দিন, জমাট বাধা রক্তে পরিণত হয়ে ৪০ দিন, গোশত আকারে ৪০ দিন। এরপর আল্লাহ একজন ফেরেশতাকে পাঠান এবং চারটি বিষয়ে আদেশ দেন যে, তার (শিশুর) আমল, রিযিক্ব, আয়ুষ্কাল ও ভালো না মন্দ সব লিপিবদ্ধ কর। অতঃপর তার মধ্যে রূহ ফুঁকে দেয়া হয়’।[5] অন্যত্র বলেন, إِنَّ اللهَ عَزَّ وَجَلَّ وَكَّلَ بِالرَّحِمِ مَلَكًا يَقُولُ يَا رَبِّ نُطْفَةٌ، يَا رَبِّ عَلَقَةٌ، يَا رَبِّ مُضْغَةٌ. فَإِذَا أَرَادَ أَنْ يَقْضِىَ خَلْقَهُ قَالَ أَذَكَرٌ أَمْ أُنْثَى شَقِىٌّ أَمْ سَعِيْدٌ فَمَا الرِّزْقُ وَالأَجَلُ فَيُكْتَبُ فِىْ بَطْنِ أُمِّهِ ‘আল্লাহ মাতৃগর্ভে একজন ফেরেশতা মোতায়েন করেন। ফেরেশতা বলেন, হে রব! এখনো তো ভ্রুণ মাত্র। হে রব! এখন জমাট বাঁধা রক্তপিন্ডে পরিণত হয়েছে। হে রব! এবার গোশতের টুকরায় পরিণত হয়েছে। আল্লাহ যদি তাকে সৃষ্টি করতে চান, তখন ফেরেশতাটি বলেন, হে আমার রব! (সন্তানটি) ছেলে না মেয়ে হবে, পাপী না নেক্কার, রিযিক্ব কি পরিমাণ ও আয়ুষ্কাল কত হবে? অতএব এভাবে তার তাক্বদীর মাতৃগর্ভে লিপিবদ্ধ করে দেয়া হয়’।[6]
নারী ও পুরুষের বীর্যের সংমিশ্রণ ঘুরতে থাকে এবং কয়েক ঘণ্টার মধ্যে এর চতুর্দিকে একটি আবরণের সৃষ্টি হয়। যাতে করে ভ্রুণটি ধ্বংস হ’তে না পারে। এরপর আস্তে আস্তে এক বিন্দু রক্তকণায় পরিণত হয় এবং সেই রক্তকণা গোশতপিন্ডে অস্থিমজ্জায় পরিণত হয়, এভাবেই সৃষ্টি হয় মানব শিশু।[7] মাতৃগর্ভে শিশুকে সংরক্ষণের জন্য মাতৃ জঠরের তিনটি পর্দা বা সন্তারের কথা কুরআনে বলা হয়েছে। যথা- পেট বা গর্ভ, রেহেম বা জরায়ু এবং ভ্রুণের আবরণ বা ভ্রুণের ঝিল্লি গর্ভফুল (Placenta)।[8] এই তিন সন্তান সম্পর্কে আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন, يَخْلُقُكُمْ فِي بُطُونِ أُمَّهَاتِكُمْ خَلْقًا مِنْ بَعْدِ خَلْقٍ فِي ظُلُمَاتٍ ثَلَاثٍ. ‘তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন, তোমাদের মাতৃগর্ভে পর্যায়ক্রমে একের পর এক ত্রিবিধ অন্ধকারে’ (যুমার ৩৯/৬)।
২. পুত্র-কন্যা সন্তান সৃষ্টির গূঢ় রহস্য :
নারীর গর্ভ সঞ্চার হওয়ার পর ২৮০ দিনের মধ্যে ১২০ দিন অতিবাহিত হ’লে পুত্র না কন্যা সন্তান ভূমিষ্ঠ হবে তা নিশ্চিত হওয়া যায়। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন, لِلَّهِ مُلْكُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ يَخْلُقُ مَا يَشَاءُ يَهَبُ لِمَنْ يَشَاءُ إِنَاثًا وَيَهَبُ لِمَنْ يَشَاءُ الذُّكُورَ أَوْ يُزَوِّجُهُمْ ذُكْرَانًا وَإِنَاثًا وَيَجْعَلُ مَنْ يَشَاءُ عَقِيمًا إِنَّهُ عَلِيمٌ قَدِيرٌ ‘নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের রাজত্ব আল্লাহ্। তিনি যা ইচ্ছা সৃষ্টি করেন, যাকে ইচ্ছা কন্যা এবং যাকে ইচ্ছা পুত্র সন্তান দান করেন। অথবা তাদের পুত্র-কন্যা উভয় দান করেন এবং যাকে ইচ্ছা বন্ধ্যা করে দেন। নিশ্চয়ই তিনি সর্বজ্ঞ, ক্ষমতাশীল’ (শূরা ৪২/৪৯-৫০)।
উম্মে সালমা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, সন্তানের (ছাঃ)-এর খিদমতে উম্মে সুলাইম (রাঃ) এসে বললেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! আল্লাহ্ হক্ব কথা প্রকাশ করতে লজ্জাবোধ করেন না। স্ত্রীলোকের স্বপ্নদোষ হ’লে কি গোসল করতে হবে? রাসূল (ছাঃ) বললেন, إِذَا رَأَتِ الْمَاءَ. ‘যখন সে বীর্য দেখতে পাবে’। তখন উম্মে সালমা (লজ্জায়) তাঁর মুখ ঢেকে নিয়ে বললেন, স্ত্রীলোকের স্বপ্নদোষ হয় কি?’ তিনি বললেন, نَعَمْ تَرِبَتْ يَمِينُكِ فَبِمَ يُشْبِهُهَا وَلَدُهَا. ‘হ্যাঁ, তোমার ডান হাতে মাটি পড়ুক! (তা না হ’লে) তাঁর সন্তান তাঁর আকৃতি পায় কিরূপে ?[9]
উম্মে সুলাইম (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুলল্লাহ (ছাঃ) বলেন, إِنَّ مَاءَ الرَّجُلِ غَلِيظٌ أَبْيَضُ وَمَاءَ الْمَرْأَةِ رَقِيقٌ أَصْفَرُ فَمِنْ أَيِّهِمَا عَلاَ أَوْ سَبَقَ يَكُونُ مِنْهُ الشَّبَهُ. ‘সাধারণত পুরুষের বীর্য গাঢ় ও সাদা। স্ত্রীলোকের বীর্য পাতলা ও হলদে। পুরুষের বীর্য স্ত্রীর বীর্যের উপর প্রাধান্য লাভ করলে পুত্র সন্তান জন্ম নেয়। আবার স্ত্রীর বীর্য পুরুষের বীর্যের উপর প্রাধান্য লাভ করলে কন্যা সন্তান জন্ম নেয়’।[10] অন্যত্র রাসূলুল্লাহ্ (ছাঃ) বলেছেন, ‘পুরুষ যখন স্ত্রীর সাথে সহবাস করে তখন যদি পুরুষের বীর্য প্রথমে স্খলিত হয়, তাহ’লে সন্তান পিতার আকৃতি পায়। পক্ষান্তরে যদি স্ত্রীর বীর্য প্রথমে স্খলিত হয়, তাহ’লে সন্তান মায়ের আকৃতি লাভ করে’।[11]
আধুনিক স্বাস্থ্যবিজ্ঞানের মতে, জরায়ুতে যদি কন্যা ভ্রুণ সৃষ্টি হয়, তাহ’লে করটেক্স কম্পোন্যান্টগুলি (Cortics Componant) বৃদ্ধি প্রাপ্ত হ’তে থাকে এবং মেডুলার কম্পোন্যান্টগুলি (Medullar Componant) কমতে থাকে। পক্ষান্তরে জরায়ুতে যদি পুত্র ভ্রুণ সৃষ্টি হয়, তাহ’লে করটেক্স কম্পোন্যান্টগুলি (Cortics Componant) কমতে থাকে এবং মেডুলার কম্পোন্যান্টগুলি (Medullar Componant) বৃদ্ধি প্রাপ্ত হ’তে থাকে।[12]
তাছাড়া মানুষের প্রতিটি দেহকোষে মোট ২৩ জোড়া ক্রমোজম থাকে। তন্মধ্যে ২২ জোড়া অটোজম এবং এক জোড়া সেক্স (Sex) ক্রমোজম। নারীর ডিম্বাণুতে XX ক্রমোজোম এবং পুরুষের শুক্রাণুতে XY ক্রমোজম থাকে। সুতরাং নারীর ডিম্বাণুর X ক্রমোজমকে যদি পুরুষের শুক্রাণুর X ক্রমোজম নিষিক্ত করে, তবে জাইগোটের ক্রমোজম হবে XX এবং কন্যা সন্তানের জন্ম হবে। পক্ষান্তরে নারীর ডিম্বাণুর X ক্রমোজমকে যদি পুরুষের শুক্রাণুর Y ক্রমোজম নিষিক্ত করে, তবে জাইগোটের ক্রমোজম হবে XY এবং পুত্র সন্তান জন্ম হবে।[13] মোদ্দাকথা, যখন ডিম্বাণুর ও শুক্রাণুর জাইগোটের ক্রমোজম একই গোত্রীয় (XX) হয়, তখন কন্যা সন্তান এবং যখন ডিম্বাণুর ও শুক্রাণুর জাইগোটের ক্রমোজম একই গোত্রীয় (XY) না হয়, তখন পুত্র সন্তান জন্ম নেয়।[14]
অতএব সন্তানের লিঙ্গ নির্ধারণ নির্ভর করে পুরুষের দেহে উৎপন্ন শুক্রাণুর উপর। আর যমজ সন্তান জন্মদানের জন্য সবচেয়ে বেশী ভূমিকা স্ত্রীর। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের মতে, নারীর ডিম্বাশয় থেকে যখন একটি ডিম্বাণু জরায়ুতে নেমে আসে, তখন একটি শক্তিশালী শুক্রাণু তাতে প্রবেশ করে একটি সন্তানের জন্ম হয়। কিন্তু যদি দু’টি ডিম্বাণু জরায়ুতে নেমে আসে, তখন দু’টি শক্তিশালী শুক্রাণু তাতে আলাদা আলাদা প্রবেশ করে। ফলে যমজ সন্তানের জন্ম হয়।[15] এভাবেই সন্তান সৃষ্টির গূঢ় রহস্য বেরিয়ে এসেছে।
৩. প্রাক-ইসলামী যুগে কন্যা সন্তানের মর্যাদা :
প্রাক-ইসলামী আরবে নিয়ম ছিল, যদি তাদের কন্যা জন্মলাভ করত, তাহ’লে তারা কন্যা হওয়াকে নিজের জন্য অমঙ্গল ও অপমানের কারণ মনে করত। সন্তান জন্মের কিছুদিন পূর্ব থেকেই তারা মানুষের আড়াল হয়ে যেত, মানুষের কাছ থেকে লুকিয়ে বেড়াতো যে, জানা নেই আমার ঘরে কী সন্তান জন্মলাভ করবে। পরে যদি ছেলে সন্তান হতো এটাকে তার জন্য সম্মানের বিষয় মনে করত।
ক. কন্যা সন্তান জীবন্ত প্রোথিত করণ :
কন্যা সন্তানকে অমঙ্গল ও অপমানের কারণ মনে করা হতো প্রাক-ইসলামী যুগে। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন, وَإِذَا بُشِّرَ أَحَدُهُمْ بِالْأُنْثَى ظَلَّ وَجْهُهُ مُسْوَدًّا وَهُوَ كَظِيمٌ. يَتَوَارَى مِنَ الْقَوْمِ مِنْ سُوءِ مَا بُشِّرَ بِهِ أَيُمْسِكُهُ عَلَى هُونٍ أَمْ يَدُسُّهُ فِي التُّرَابِ أَلَا سَاءَ مَا يَحْكُمُونَ. ‘তাদের কাউকে যখন কন্যা সন্তানের সুসংবাদ দেয়া হয় তখন তার মুখমন্ডল কালো হয়ে যায় এবং সে অসহনীয় মনোন্তাপে ক্লিষ্ট হয়। তাকে যে সুসংবাদ দেয়া হয়, তার গ্লানী হেতু সে নিজ সম্প্রদায় হ’তে আত্মগোপন করে; সে চিন্তা করে যে, হীনতা সত্ত্বেও সে তাকে রেখে দিবে, না মাটিতে পুঁতে দিবে। লক্ষ্য করো, সে কত নিকৃষ্ট সিদ্ধান্ত স্থির করেছিল’ (নাহল ১৬/৫৮-৫৯)। অন্যত্র বলেন, وَإِذَا الْمَوْءُودَةُ سُئِلَتْ . بِأَيِّ ذَنْبٍ قُتِلَتْ. ‘যখন জীবন্ত-প্রথিত কন্যাকে জিজ্ঞাসা করা হবে, কি অপরাধে তাকে হত্যা করা হয়েছিল’(তাক্ববীর ৮১ /৮-৯)?
জাহেলী যুগে কন্যা সন্তানকে জীবন্ত পুঁতে ফেলা হতো। আর এভাবে জীবন্ত কবরস্থ করা হারাম করেছে। মুগীরাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, إِنَّ اللَّهَ حَرَّمَ عَلَيْكُمْ عُقُوقَ الأُمَّهَاتِ ، وَوَأْدَ الْبَنَاتِ ، وَمَنَعَ وَهَاتِ ، وَكَرِهَ لَكُمْ قِيلَ وَقَالَ ، وَكَثْرَةَ السُّؤَالِ، وَإِضَاعَةَ الْمَالِ ‘আল্লাহ্ তা‘আলা তোমাদের উপরে মায়ের অবাধ্যতা, কন্যাদের জীবন্ত প্রোথিতকরণ, কৃপণতা ও ভিক্ষাবৃত্তি হারাম করেছেন। আর তোমাদের জন্য বৃথা তর্ক-বিতর্ক, অধিক সাওয়াল করা ও সম্পদ বিনষ্ট অপছন্দ করেছেন’।[16]
খ. জীবন্ত প্রোথিতকরণে উভয়ে জাহান্নামী :
জীবন্তকন্যা সন্তানকে পুঁতে ফেলা ইসলাম হারাম করেছে এবং যারা বিগত দিনে এমন করেছেন তারা উভয়ে জাহান্নামী। সালামাহ বিন ইয়াজিদ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, মুলায়কা নামণী জনৈকা মহিলার দুই ছেলে এসে তার মা সম্পর্কে রাসূল (ছাঃ)-কে প্রশ্ন করেন যে, আমার মা জাহেলী যুগে মারা গেছেন। কিন্তু তিনি আত্মীয়তা সম্পর্ক রক্ষাকারীনী, অতিথিপরায়ণা এবং বিভিন্ন সৎকর্মে অভ্যন্ত ছিলেন। কিন্তু তিনি আমাদের একটি বোনকে প্রোথিত করার মাধ্যমে হত্যা করেন। এমতাবস্থায় তার সৎকর্মসমূহ তার উক্ত পাপের কাফফারা হবে কি? জবাবে রাসূল (ছাঃ) বললেন, الْوَائِدَةُ وَالْمَوْءُودَةُ فِى النَّارِ إِلاَّ أَنْ تُدْرِكَ الْوَائِدَةُ الإِسْلاَمَ فَيَعْفُوَ اللَّهُ عَنْهَا. ‘প্রোথিতকারিণী ও প্রোথিত কন্যা উভয়ে জাহান্নামী হবে। তবে যদি প্রোথিতকারিণী ইসলাম কবূল করত তাহলে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করতেন’।[17] অন্যত্র বলেন, الْوَائِدَةُ وَالْمَوْؤُدَةُ فِي النَّارِ. ‘যে মহিলা তার কন্যা সন্তানকে জীবন্ত কবরস্থ করেছে এবং যে কন্যা সন্তানকে জীবন্ত প্রোথিত করা হয়েছে তারা উভয়ে জাহান্নামী।[18]
গ. জীবন্ত প্রোথিত করণের কাফ্ফারা :
জীবন্ত প্রোথিত কন্যা সন্তানের কাফ্ফারা হ’ল প্রত্যেকের জন্য একটি কওে গোলাম আযাদ করা অথবা একটি করে উট কুরবানী করা। ওমর ইবনে খাত্তাব (রাঃ) বলেন, কায়েস ইবনু আছিম (ছাঃ) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট এসে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমি জাহিলিয়াতের যুগে আমার ৮ জন কন্যাকে জীবিত প্রোথিত করেছি, এখন আমার করণীয় কি? রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, أَعْتِقْ عَنْ كُلِّ وَاحِدَةٍ مِنْهَا رَقَبَةً، ‘তুমি প্রত্যেকটি কন্যার বিনিময়ে একটি করে গোলাম আযাদ করে দাও। তখন কায়েস (রাঃ) বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমি তো উটের মালিক। আমি গোলামের মালিক নই। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, اِهْدِ إِنْ شِئْتَ عَنْ كُلِّ وَاحِدَةٍ مِنْهُنَّ بَدَنَةً. ‘তাহলে তুমি প্রত্যেকের জন্য একটি করে উট আল্লাহর নামে কুরবানী করে দাও’।[19]
ঘ. জাহেলী যুগে মহিলাদের মর্যাদা :
তৎকালীন আরবে মেয়েরা একমাত্র ভোগের সামগ্রী হিসাবে পরিগণিত হতো। বিশেষ করে ইহুদী-খৃষ্টান নারীদেরকে ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখে এবং উপভোগের বস্ত্ত হিসাবে ব্যবহার করে। নারীরা ঋতুবতী হ’লে তারা তাদেরকে ঘৃণা করে। আনাস ইবনে মালিক (রাঃ) বলেন, ইহুদীদের কোন স্ত্রীলোকের হায়েয হ’লে তারা শুধু তাদের সাথে একত্রে খাওয়া বন্ধ করে দিতো এবং একত্রে ঘরেও থাকত না বা রাখতো না। ছাহাবীগণ এ বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে জিজ্ঞেস করলেন। তখন আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে সূরা বাক্বারাহ’র ২২২ নং আয়াত অবতীর্ণ করে বলেন, وَيَسْأَلُونَكَ عَنِ الْمَحِيضِ قُلْ هُوَ أَذًى فَاعْتَزِلُوا النِّسَاءَ فِي الْمَحِيضِ وَلَا تَقْرَبُوهُنَّ حَتَّى يَطْهُرْنَ فَإِذَا تَطَهَّرْنَ فَأْتُوهُنَّ مِنْ حَيْثُ أَمَرَكُمُ اللَّهُ إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ التَّوَّابِينَ وَيُحِبُّ الْمُتَطَهِّرِينَ. ‘আর তারা তোমাকে হায়েয সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করছে। তুমি বলো, ওটা হচ্ছে অশুচি। অতএব ঋতুকালে স্ত্রীলোকদেরকে অন্তরাল করো এবং উত্তম রূপে শুদ্ধ না হওয়া পর্যন্ত তাদের নিকটে গমন করো না; অতঃপর যখন তারা পবিত্র হবে তখন আল্লাহর নির্দেশ মত তোমরা তাদের নিকট গমন করো, নিশ্চয়ই আল্লাহ তাওবাহকারীদেরকে ভালবাসেন এবং যারা পবিত্র থাকে তাদেরকেও ভালবাসেন’ (বাক্বারাহ ২/২২২)। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, اصْنَعُوا كُلَّ شَىْءٍ إِلاَّ النِّكَاحَ. ‘তাদের সাথে যৌনসঙ্গম ব্যতীত আর সব কিছু করতে পারো’। এ সংবাদ ইহুদীদের কাছে পৌঁছালে তারা বললো, এ ব্যক্তি আমাদের সব কিছুতেই বিরোধিতা না করে ছাড়তে চায় না।
অতঃপর উসায়দ ইবনু হুযাইর এবং ‘আববাদ ইবনু বিশর (রাঃ) আসলেন এবং তারা বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! ইহুদীরা এসব কথা বলে বেড়ায়। আমরা কি আমাদের স্ত্রীদের সাথে যৌনসঙ্গম করার অনুমতি পেতে পারি? এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর চেহারা বিবর্ণ হয়ে গেল। তাতে আমাদের ধারণা হ’ল, তিনি তাদের ওপর রাগ করেছেন। তারপর তারা বের হয়ে গেলেন। এমন সময় তাদের সামনেই রাসূল (ছাঃ)-এর জন্য কিছু দুধ হাদিয়া আসলো। অতঃপর তিনি লোক পাঠিয়ে তাদেরকে ডেকে এনে দুধ খেতে দিলেন। এতে তারা বুঝলেন যে, তিনি (ছাঃ) তাদের সাথে রাগ করেননি।[20]
পক্ষান্তরে ইসলাম আসার পরে মুসলমানরা নারীদের সাথে উত্তম আচরণ করতেন। হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন, ‘নাপাক অবস্থায় আমি ও রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) একই পাত্র হতে গোসল করতাম। তিনি আমাকে হুকুম করতেন, আমি শক্ত করে লুঙ্গি বেঁধে নিতাম, আর তিনি আমার গায়ে গা লাগাতেন অথচ তখন আমি হায়েয অবস্থায় ছিলাম। তিনি ই‘তিক্বাফ অবস্থায় তাঁর মাথা মাসজিদ থেকে বের করে দিতেন, আমি ঋতুবতী অবস্থায় পানি দিয়ে তাঁর মাথা ধুয়ে দিতাম’।[21] অন্যত্র তিনি বলেন, ‘আমি হায়েয অবস্থায় পানি পান করতাম। এরপর রাসূল (ছাঃ)-কে তা দিতাম। তিনি আমার মুখের জায়গায় মুখ রেখেই পানি পান করতেন। আমি কখনও হায়েয অবস্থায় হাড়ের গোশত খেয়ে নবী (ছাঃ)-কে দিতাম। তখন তিনি আমার মুখের জায়গায় মুখ রেখে তা খেতেন’।[22]
ইহুদীরা তাদের স্ত্রীদেরকে হায়েয অবস্থায় আলাদা রাখত। কিন্তু রাসূল (ছাঃ) তার বিপরীত মেয়েদের সম্মান দিলেন। হযরত মায়মূনা (রাঃ) বলেন, كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يُصَلِّى فِى مِرْطٍ، بَعْضُهُ عَلَىَّ وَبَعْضُهُ عَلَيْهِ وَأَنَا حَائِضٌ. ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) একটি চাদরে ছালাত আদায় করতেন। যার একটি অংশ আমার শরীরের উপর থাকতো এবং অন্য অংশ তাঁর শরীরের উপর থাকতো। অথচ তখন আমি ঋতুবতী’।[23]
হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন, أَنَّ النَّبِىَّ صلى الله عليه وسلم كَانَ يَتَّكِئُ فِى حَجْرِى وَأَنَا حَائِضٌ، ثُمَّ يَقْرَأُ الْقُرْآنَ. ‘আমি হায়েয অবস্থায় থাকতে রাসূল (ছাঃ) আমার কোলে হেলান দিয়ে কুরআন তিলাওয়াত করতেন’।[24] অন্যত্র তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) আমাকে বললেন, نَاوِلِينِى الْخُمْرَةَ مِنَ الْمَسْجِدِ. ‘মসজিদ হ’তে আমাকে চাটাই এনে দাও’। আমি বললাম, আমি তো ঋতুবতী। তিনি বললেন, إِنَّ حَيْضَتَكِ لَيْسَتْ فِى يَدِكِ. ‘তোমার হায়েয তো তোমার হাতে নয়’।[25]
যায়দ ইবনে আসলাম (রাঃ) বলেন, জনৈক লোক সন্তানের (ছাঃ)-কে জিজ্ঞেস করলেন, হায়েয অবস্থায় আমার স্ত্রীর সাথে কী কী করা হালাল? তখন তিনি (ছাঃ) বলেন, لِتَشُدَّ عَلَيْهَا إِزَارَهَا ثُمَّ شَأْنَكَ بِأَعْلَاهَا ‘তার পরনের পায়জামা শক্তভাবে বাঁধবে। তারপর উপরের দিকে যা ইচ্ছা করবে’।[26]
(চলবে)
—————————
[1]. মুয়াত্তা, মিশকাত হা/৪৯৪৯।
[2]. বায়হাক্বী, মিশকাত হা/৩০৯৬; ছহীহুল জামি‘ হা/৪৩০, ৬১৪৮; সনদ হাসান।
[3]. তিরমিযী; মিশকাত হা/৪৯২৭; নাসাঈ হা/৩১০৪।
[4]. বুখারী হা/৩৩৩১; মিশকাত হা/৩২৩৮, ‘বিবাহ’ অধ্যায়।
[5]. বুখারী হা/২৯৬৮, ৩০৮৬; মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ্, মিশকাত হা/৮৬।
[6]. বুখারী হা/৩০৮৭ ‘কিতাবুল আম্বিয়া’।
[7]. মুহাম্মাদ নূরুল ইসলাম, বিজ্ঞান না কুরআন, পৃঃ ১০৯-১১০।
[8]. বাইবেল, কুরআন ও বিজ্ঞান, ২৭৭পৃ., ১নং টীকা দ্রষ্টব্য।
[9]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৪৩৩।
[10]. মুসলিম, মিশকাত হা/৪৩৪।
[11]. বুখারী হা/৩০৮৩ ‘কিতাবুল আম্বিয়া’।
[12]. গাইনিকলজি শিক্ষা, ৪১ পৃ.।
[13]. মাধ্যমিক সাধারণ বিজ্ঞান, জীব কোষের গঠন ও প্রকৃতি অধ্যায়, (ঢাকা : নব পুথিঘর প্রকাশনী), পৃঃ ১৬১।
[14]. J.N.Ghoshal, Anatomy Physcolosy, (Calcata print) P. 479.
[15]. গাইনিকলজি শিক্ষা, ১৫ পৃ.।
[16]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৪৯১৫।
[17]. আহমাদ হা/১৫৯৬৫; সনদ ছহীহ।
[18]. আবূদাঊদ হা/৪৭১৭; মিশকাত হা/১১২; ইবনে হিববান হা/৭৪৮০।
[19]. বাযযার, ত্বাবারানী, ইবনু কাছীর হা/৭১৭১।
[20]. মুসলিম, মিশকাত হা/৫৪৫; আহমাদ হা/১২৩৭৬; দারেমী হা/১০৫৩।
[21]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৫৪৬।
[22]. মুসলিম হা/৩০০; মিশকাত হা/৫৪৭।
[23]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৫৫০।
[24]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৫৪৮।
[25]. মুসলিম হা/২৯৮-৯৯, মিশকাত হা/৫৪৯; আবূদাউদ হা/২৬১।
[26]. মুয়াত্তা, দারিমী, মিশকাত হা/৫৫৫।