দাজ্জাল কি জীবিত (?)

দাজ্জাল : আরবী শব্দ المسيح الدجّال‎, প্রতিবর্ণী. al-Masīḥ ad-Dajjāl‎; প্রতিবর্ণী. মসিহা দগ্গাল) ইসলামি বিধান অনুসারে একটি অশুভ চরিত্র। বিভিন্ন স্থান থেকে—সাধারণত পূর্বাঞ্চল, খোরাসান বা সিরিয়া ও ইরানের মধ্যবর্তী কোনো এলাকা থেকে—তার আগমন ঘটবে বলে ধারণা করা। দাজ্জাল চরিত্রটি খ্রিষ্টান পরলোকতত্ত্বে বর্ণিত খ্রিষ্টারি চরিত্রের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ।

দাজ্জাল পূর্ব থেকেই জীবিত রয়েছে এবং বিখ্যাত ছাহাবী তামীম দারী (রাঃ) ও তার ত্রিশজন সাথী সাগরে পথ হারিয়ে এক দ্বীপে গিয়ে ওঠেন। সেখানে পানির খোঁজে বের হ’লে একজন ব্যক্তির সঙ্গে দেখা হয়। যে তার চুল টেনে নিয়ে চলছিল। অতঃপর তিনি দাজ্জালের কাহিনী বর্ণনা করেন। যেখানে দাজ্জালের বক্তব্য এসেছে এভাবে যে, যদি আমাকে এখান থেকে বের হওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়, তাহ’লে আমি পুরা পৃথিবী ধ্বংস করে দেব মদীনা ব্যতীত। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) লোকদের মাঝে নিয়ে এলেন এবং সে তাদেরকে পূর্ণ বৃত্তান্ত বর্ণনা করে শুনাল। রাসূল (ছাঃ) বললেন, এ শহরটি হ’ল ত্বাইবাহ (মদীনা)। আর সে হ’ল দাজ্জাল’ (মুসলিম হা/২৯৪২ (১২১)। অন্য বর্ণনায় রাসূল (ছাঃ) বলেন, দাজ্জাল শেষ যামানায় খোরাসান থেকে বের হবে’ (তিরমিযী হা/২২৩৭; ইবনু মাজাহ হা/৪০৭২)

ফাত্বিমাহ্ বিনতু কায়স (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা.) -কে সালাতের জন্য ঘোষণা দিতে শুনতে পেলাম। সালাত শেষ করে তিনি (সা.) মিম্বারে উপবিষ্ট হলেন এবং মুচকি হেসে বললেন, প্রত্যেক লোক নিজ নিজ সালাতের স্থানে বসে থাক। অতঃপর বললেন, তোমরা কি জান, আমি তোমাদেরকে কেন একত্রিত করেছি? সাহাবীগণ বললেন, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই অধিক জানেন। তিনি (সা.) বললেন, আল্লাহর শপথ! আমি তোমাদেরকে কিছু দেয়ার জন্য বা কোন ভয়ভীতি প্রদর্শনের জন্য সমবেত করিনি; তোমাদেরকে একত্রিত করেছি বরং তামীম আদ্ দারী-এর বর্ণিত একটি ঘটনা শুনানোর জন্যই। তামীম আদ দারী ছিলেন একজন খ্রিস্টান, তিনি (আমার নিকট) এসে ইসলাম গ্রহণ করেছেন। তিনি আমাকে এমন একটি ঘটনা শুনিয়েছেন, এটা ঐ কথারই সাথে মিল রাখে যা আমি তোমাদেরকে মাসীহে দাজ্জাল সম্পর্কে বলেছিলাম। তিনি বলেছেন, একবার তিনি ’লাম ও জুযাম’ গোত্রের ত্রিশজন লোকের সঙ্গে একটি সামুদ্রিক নৌকায় সফরে বের হয়েছিলেন। সাগরের ঢেউ তাদেরকে দীর্ঘ একমাস পর্যন্ত এদিক সেদিক ঘুরাতে ঘুরাতে পরিশেষে একদিন সূর্যাস্তের সময় একটি দ্বীপের অভ্যন্তরে প্রবেশ করলেন এবং সেখানে তারা এমন একটি জানোয়ার দেখতে পেলেন যার সমস্ত দেহ বড় বড় পশমে ঢাকা। অধিক পশমের কারণে তার অগ্র-পশ্চাৎ কিছুই নির্ণয় করা যায়নি। তখন তারা তাকে লক্ষ্য করে বললেন, তোর অকল্যাণ হোক! তুই কে? সে বলল, আমি ’জাসসাসাহ্ (অর্থাৎ গুপ্ত সংবাদ অন্বেষণকারিণী)। তোমাদের তথ্যাদি শুনার ও জানার প্রত্যাশী।

তামীম আদ দারী বলেন, উক্ত জন্তুর কাছে লোকটির কথা শুনে তার প্রতি আমাদের অন্তরে ভয় সঞ্চার হলো যে, তা জিন হতে পারে। তখন আমরা দ্রুত সেখানে গেলাম এবং গির্জায় প্রবেশ করে সেখানে এমন একটি প্রকাণ্ড দেহবিশিষ্ট মানুষ দেখতে পেলাম যা ইতোপূর্বে আমরা আর কখনো দেখতে পাইনি। সে ছিল খুব মজবুত করে বাঁধা অবস্থায়, তার হাত ঘাড়ের সাথে এবং হাঁটুদ্বয় নিচের উভয় গিটের সাথে লৌহশিকল দিয়ে একত্রে বাঁধা ছিল। আমরা তাকে বললাম, তোর অকল্যাণ হোক! তুই কে? সে বলল, নিশ্চয় তোমরা আমার সম্পর্কে জানতে পারবে, তবে তোমরা আগে আমাকে বল দেখি তোমরা কে? তারা বললেন, আমরা ’আরবের লোক। আমরা সমুদ্রে একটি নৌকায় আরোহী ছিলাম দীর্ঘ একমাস সাগরের তরঙ্গ আমাদেরকে এদিক-সেদিক ঘুরিয়ে এখানে এনে পৌঁছিয়েছে। অতঃপর আমরা এ দ্বীপে প্রবেশ করার পর সারা দেহ ঘন লোমে আবৃত এমন একটি জন্তুর সাথে আমাদের দেখা হলো। সে বলল, আমি ’জাসসাসাহ্।
সে আমাদেরকে এ গির্জায় আসতে বলায় আমরা দ্রুত তোমার কাছে এসে উপস্থিত হয়েছি।

সে বলল, আচ্ছা তোমরা আমাকে বল দেখি! বায়সান এলাকার খেজুর বাগানে ফল আসে কি? (বায়সান হিজাযের একটি জায়গার নাম) আমরা বললাম, হ্যা, আসে। সে বলল, সেই বাগানের গাছে অদূর ভবিষ্যতে ফল ধরবে না। অতঃপর সে বলল, আচ্ছা বল দেখি! ’তবারিয়্যাহ্’-এর নদীতে কি পানি আছে? আমরা বললাম, হ্যা, তাতে প্রচুর পরিমাণে পানি আছে। সে বলল, অচিরেই তার পানি শুকিয়ে যাবে। এবার সে প্রশ্ন করল, আচ্ছা বল দেখি! ’যোগার’ ঝরনার পানি আছে কি? আর তথাকার অধিবাসীগণ কি উক্ত ঝরনার পানি দ্বারা তাদের ক্ষেত-খামারে চাষাবাদ করে। অতঃপর সে প্রশ্ন করল, আচ্ছা বল দেখি! উম্মিদের নবীর সংবাদ কী? আমরা বললাম, তিনি মক্কাহ থেকে হিজরত করে বর্তমান ইয়াসরিব (মদীনায় অবস্থান করছেন। সে প্রশ্ন করল, বল দেখি! ’আরবরা কি তার সাথে লড়াই করেছিল? আমরা বললাম, হ্যা, করেছে। সে প্রশ্ন করল, তিনি (সে নবী) তাদের সাথে কি আচরণ করেছেন? এর উত্তরে আমরা বললাম যে, তার আশেপাশের ’আরবদের ওপরে তিনি জয়ী হয়েছেন এবং তারা তাঁর আনুগত্য স্বীকার করেছে। এতদশ্রবণে সে বলল, তোমরা জেনে রাখ! তার আনুগত্য করাই তাদের পক্ষে কল্যাণজনক হয়েছে।

আচ্ছা এখন আমি আমার অবস্থা বর্ণনা করছি আমি মাসীহে দাজ্জাল, অদূর ভবিষ্যতে আমাকে বের হওয়ার অনুমতি প্রদান করা হবে। আমি বের হয়ে জমিনে বিচরণ করব। মক্কাহ্-মদীনাহ্ ছাড়া এমন কোন জনপদ বাকি থাকবে না, চল্লিশ দিনের মধ্যে যেখানে আমি প্রবেশ করব না। সেই দু স্থানে প্রবেশ করা আমার ওপরে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। যখনই আমি তার একটিতে প্রবেশ করতে চাইব, তখন নাঙ্গা তরবারি হাতে মালাক (ফেরেশতা) এসে আমাকে প্রবেশ করা হতে বাধা প্রদান করবে। মূলত তার প্রত্যেক প্রবেশ পথে মালাক পাহারারত রয়েছে। বর্ণনাকারী বলেন, এ পর্যন্ত বর্ণনা করে রাসূলুল্লাহ (সা.) – নিজ লাঠি দ্বারা মিম্বারে টোকা দিয়ে বললেন, এটা ত্বায়বাহ্, এটা ত্বায়বাহ্, এটা ত্বায়বাহ্ (মদীনাহ্)। অতঃপর তিনি (সা.) বললেন, বল দেখি! এর আগে আমি কি তোমাদেরকে এ হাদীস বর্ণনা করিনি? লোকেরা বলল, জী হ্যা। অতঃপর তিনি (সা.) বললেন, দাজ্জাল সিরিয়ার কোন এক দরিয়ায় অথবা ইয়ামানের কোন এক দরিয়ায় আছে। পরে বললেন, না, বরং সে পূর্বদিক হতে আগমন করবে। এ বলে তিনি (সা.) হাত দ্বারা পূর্বদিকে ইঙ্গিত করলেন। (আবুদাঊদ হা/৪৩২৫; মিশকাত হা/৫৪৮২, ৫৪৮৪)

“সাবধান! নিশ্চয় সে (দাজ্জাল) সিরিয়ার পার্শ্বের সাগরে অথবা ইয়ামানের সাগরের পার্শ্বে অবস্থান করছে।” তিনি (তামীম আদ দারী-এর কথা অনুযায়ী) স্পষ্ট করে তার অবস্থান বর্ণনা করেননি। এতে কোন কল্যাণ থাকতে পারে। যেহেতু ‘আরবগণ সে সময় এই দুই সাগরেই গমন করত। মূলত সাগর একটাই যা আরব উপদ্বীপের পাশ দিয়ে দীর্ঘভাবে প্রবাহিত হয়েছে। এরপর তিনি উক্ত মত দুটিকে বাতিল করে সঠিক মতামত পেশ করে হাতের ইশারায় দেখিয়ে দিলেন যে, সে পূর্বদিক থেকে আবির্ভূত হবে। (মিরক্বাতুল মাফাতীহ)।

উক্ত হাদীছদ্বয়ে বুঝা যায় যে, দাজ্জাল পূর্ব থেকেই জীবিত রয়েছে এবং শেষ যামানায় ক্বিয়ামতের প্রাক্কালে বের হবে। এক্ষণে ইবনু ছাইয়াদকে দাজ্জাল হিসাবে রাসূল (ছাঃ) ও ছাহাবীগণের সন্দেহের কারণ হ’ল, রাসূল (ছাঃ)-কে দাজ্জালের আগমনের সময় সম্পর্কে অবহিত করা হয়নি। সেকারণ তাঁর ও ছাহাবীগণের মনে সন্দেহ ছিল। তবে এই সন্দেহ দূর হয়ে যায় যখন ইবনু ছাইয়াদ হজ্জ সম্পাদন করে। যেমন হাদীছে এসেছে যে, হজ্জের সফরে ইবনু ছাইয়াদ আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ)-কে আপ্যায়ন করতে চাইলে তিনি অনীহা প্রকাশ করেন। এই অবস্থা দেখে ইবনু ছাইয়াদ বলল, হে আবু সাঈদ! লোকেরা আমার ব্যাপারে যেসব কথা বলে তাতে আমার ইচ্ছা হয় যে, আমি একটি রশি নিয়ে সেটা গাছে লটকিয়ে ফাঁসি দিয়ে মরে যাই এবং এ থেকে পরিত্রাণ পাই। তারপর সে বলল, হে আবু সাঈদ! তোমাদের আনছারদের নিকট রাসূল (ছাঃ)-এর কোন হাদীছ গোপন নেই। তুমি কি রাসূল (ছাঃ)-এর হাদীছ সম্বন্ধে সবচেয়ে বেশী জ্ঞাত নও? রাসূল (ছাঃ) কি বলেননি যে, সে ব্যক্তি (দাজ্জাল) কাফির হবে? অথচ আমি মুসলিম। তিনি কি বলেননি যে, দাজ্জাল নিঃসন্তান হবে। অথচ মদীনায় আমি আমার সন্তান রেখে এসেছি। রাসূল (ছাঃ) কি বলেননি যে, দাজ্জাল মক্কা-মদীনায় প্রবেশ করতে পারবে না। অথচ আমি মদীনা থেকে এসেছি। আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) বলেন, তার কথায় আমি তাকে বিশ্বাস করার কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিলাম। অতঃপর ইবনু ছাইয়াদ বলল, আল্লাহর কসম! আমি তাকে (দাজ্জালকে) চিনি, তার জন্মস্থান চিনি এবং এখন সে কোথায় আছে, তাও আমি জানি। এ কথা শুনে আমি বললাম, তোমার সারাটা দিন ধ্বংস হোক’ (মুসলিম হা/২৯২৭ (৯১)

উক্ত হাদীছের শেষাংশে ইবনু ছাইয়াদ সন্দেহের তীর ছুঁড়েছে। সেজন্য হাফেয ইবনু হাজার (রহঃ) এই সংক্রান্ত হাদীছগুলির সমন্বয় করে বলেন, তামীম দারী (রাঃ) যে দাজ্জালকে দেখে এসেছেন সে-ই প্রকৃত দাজ্জাল। আর শয়তান ইবনু ছাইয়াদের রূপ ধারণ করে দাজ্জালী কর্মকান্ড ঘটিয়ে রাসূল (ছাঃ) সহ ছাহাবায়ে কেরামকে সন্দেহে নিক্ষেপ করেতে চেয়েছিল। সেজন্য সে হাররার দিন ইছফাহানের দিকে রওয়ানা দিয়ে হারিয়ে যায়। যাকে পরবর্তীতে কোথাও দেখা যায়নি (ফাহুল বারী ১৩/৩৮০)। ‘হাররার দিন’ অর্থ ইয়াযীদের সেনাবাহিনী কর্তৃক মদীনা অবরোধের দিন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

loader-image

Scroll to Top