সাধারণ অযাচিত পাপের কারণে নিরাশ হবেন না। তবে কর্মে স্বেচ্ছাচারিতার ব্যাপারে অনুমতি প্রদান করা হয়নি। আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,
وَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ لَوْ لَمْ تُذْنِبُوا لَذَهَبَ اللَّهُ بِكُمْ وَلَجَاءَ بِقَوْمٍ يُذْنِبُونَ فَيَسْتَغْفِرُونَ اللَّهَ فَيَغْفِرُ لَهُمْ ” .
‘যে সত্তার হাতে আমার জীবন, আমি তার কসম করে বলছি, তোমরা যদি পাপ না করতে তবে অবশ্যই আল্লাহ তোমাদের নিশ্চিহ্ন করে এমন সম্প্রদায় বানাতেন যারা পাপ করে ক্ষমা চাইতো এবং তিনি তাদের মাফ করে দিতেন’ (মুসলিম হা/২৭৪৯; মিশকাত হা/২৩২৮)।
ব্যাখ্যা : আল্লাহ তা‘আলা ফেরেশতাকে যে বৈশিষ্ট্যের উপর তৈরি করেছেন তোমাদেরকে যদি সে বৈশিষ্ট্যের উপর তৈরি করা হত, তাহলে অবশ্যই আল্লাহ এমন জাতি নিয়ে আসতেন যাদের দ্বারা গুনাহ সম্পাদিত হত। অতঃপর আল্লাহ কৌশলের চাহিদা মোতাবেক তাদের কাছে ঐ সমস্ত গুণাবলী নিয়ে প্রকাশ পেতেন, কেননা তিনি গাফফার যার বৈশিষ্ট্য ক্ষমা করা, যেমনি তিনি রাযযাক যার বৈশিষ্ট্য দান করা।
তুরবিশতী বলেন, এ হাদীস থেকে উদ্দেশ্য হল, নিশ্চয়ই আল্লাহ যেমন দয়াকারীর প্রতি দয়া করতে ভালবাসেন তেমনি পাপীর পাপ এড়িয়ে চলাও পছন্দ করেন। আর এর উপর প্রমাণ বহন করে আল্লাহর একাধিক নাম, গাফফার, তাওয়াব, হালীম এবং ‘আফুব্যু। সুতরাং আল্লাহ এমন নন যে, বান্দাদেরকে গুনাহ থেকে বিরত থাকতে মালায়িকাহর (ফেরেশতার) মতো তাদেরকে একই গুণের উপর সৃষ্টি করবেন। বরং তাদের মাঝে এমন কাউকে সৃষ্টি করবেন যে তার স্বভাব অনুযায়ী প্রবৃত্তির দিকে ঝুকবে ফিতনাহগ্রস্ত হবে এবং প্রবৃত্তির প্রতি সংশয়পূর্ণ হবে। অতঃপর তাকে তা থেকে বেঁচে থাকতে তাকে দায়িত্ব দিবেন, অপরাধী হওয়া থেকে তাকে সতর্ক করবে। পরীক্ষায় পতিত করার পর তাকে তাওবার সাথে পরিচিত করবো। সুতরাং বান্দা যদি আল্লাহর সাথে কৃত প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করে তাহলে তার পুণ্য আল্লাহর কাছে থাকবে। পক্ষান্তরে পথ ভুল করলে তার সামনে তাওবাহ্ করার সুযোগ থাকবে।
রাসূল (ছাঃ) বলেন,إنَّ الله تَعَالَى يَبْسُطُ يَدَهُ بِاللَّيْلِ لِيَتُوْبَ مُسِيْئ النَّهَارِ، ويَبْسُطُ يَدَهُ بِالنَّهَارِ لِيَتُوْبَ مُسِيْئ اللَّيْلِ، حَتَّى تَطْلُعَ الشَّمْسُ مِنْ مَغْرِبِهَا- ‘আল্লাহ তা‘আলা রাতে স্বীয় হাত প্রসারিত করেন, যাতে দিনের গোনাহগার যারা তারা তওবা করে। আবার দিনের বেলায় হাত প্রসারিত করেন যাতে রাতের গোনাহগার ব্যক্তিরা তওবা করে। এভাবে তিনি ক্ষমার হাত প্রসারিত করতে থাকবেন পশ্চিম দিকে সূর্য উদিত হওয়া পর্যন্ত’ (মুসলিম, মিশকাত হা/২৩২৯)।
ব্যাখ্যা: (إِنَّ اللّٰهَ يَبْسُطُ يَدَه) বলা হয়েছে, হাদীসাংশে হাত প্রশস্ত করা এর দ্বারা উদ্দেশ্য অনুসন্ধান করা। কেননা মানুষের স্বভাব হল তাদের কেউ যখন কারো কাছ থেকে কিছু সন্ধান করে তখন সে তার দিকে নিজ হাতের তালুকে বিস্তৃত করে, অর্থাৎ- আল্লাহ পাপীদেরকে তাওবার দিকে আহবান করছেন।
(لِيَتُوبَ مُسِىْءُ النَّهَارِ) অর্থাৎ- তাদের শাস্তির ব্যাপারে তিনি তাড়াতাড়ি করেন না বরং তাদেরকে তিনি ঢিল দেন যাতে তারা তাওবাহ্ করে।
(وَيَبْسُطُ يَدَه بِالنَّهَارِ لِيَتُوبَ مُسِىْءُ اللَّيْلِ) নাবাবী বলেন, এর অর্থ হল, তিনি পাপীদের থেকে দিনে রাত্রে তাওবাহ্ গ্রহণ করবেন যতক্ষণ পর্যন্ত পশ্চিম দিক থেকে সূর্য না উদিত হবে। আর তিনি তার তাওবাহ্ গ্রহণ কোন সময়ের সাথে নির্দিষ্ট করেননি। সুতরাং তাওবাহ্ গ্রহণের ক্ষেত্রে হাত বিস্তৃতকরণ রূপকার্থবোধক। মাযুরী বলেন, হাত বিস্তৃতকরণ দ্বারা তাওবাহ্ গ্রহণ উদ্দেশ্য। হাদীসে কেবল হাত বিস্তৃতকরণ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে, কেননা ‘আরবরা যখন কোন জিনিসের প্রতি সন্তুষ্ট থাকে তখন সে তার হাতকে তা গ্রহণের জন্য বিস্তৃত করে এবং যখন কোন জিনিসকে অপছন্দ করে তখন তার হাতকে সে জিনিস থেকে গুটিয়ে নেয়। অতএব তাদেরকে ইন্দ্রিয়ানুভূত বিষয় দ্বারা সম্বোধন করা হয়েছে যা তারা বুঝে আর তা রূপকার্থবোধক, কেননা আল্লাহর ক্ষেত্রে দোষণীয় হাত সাব্যস্ত করা অসম্ভব, আল্লাহর হাত আল্লাহর মতো।
(حَتّٰى تَطْلُعَ الشَّمْسُ مِنْ مَغْرِبِهَا) অর্থাৎ- ‘‘তখন তাওবার দরজা বন্ধ করে দেয়া হবে’’। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘‘যেদিন আপনার পালনকর্তার কিছু নিদর্শন আগমন করবে তখন কোন আত্মার ঈমান আনয়ন তার কোন কাজে আসবে না’’- (সূরা আল আন্‘আম ৬ : ১৮৫)।
ইবনুল মালিক বলেন, এ হাদীসের অর্থ এবং এর মতো অন্যান্য হাদীস ঐ ব্যাপারে প্রমাণ বহন করছে যে, পশ্চিম দিকে সূর্য উদিত হওয়ার পর থেকে নিয়ে কিয়ামাত সংঘটিত হওয়া পর্যন্ত তাওবাহ্ গ্রহণ করা হবে না।
আপর হাদীছে এসেছে, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘কোন বান্দা অপরাধ করল এবং বলল, হে আমার প্রতিপালক! আমি অপরাধ করেছি, তুমি তা ক্ষমা কর। তখন আল্লাহ বলেন, (হে আমার ফিরিশতাগণ!) আমার বান্দা কি জানে যে তার একজন প্রতিপালক আছেন, যিনি অপরাধ ক্ষমা করেন অথবা অপরাধের কারণে শাস্তি দেন? (তোমরা সাক্ষী থাক) আমি তাকে ক্ষমা করে দিলাম। অতঃপর আল্লাহ যতদিন চাইলেন ততদিন সে অপরাধ না করে থাকল। আবার অপরাধ করল এবং বলল, হে আমার প্রতিপালক! আমি আবার অপরাধ করেছি, তুমি আমাকে ক্ষমা কর। তখন আল্লাহ বলেন, আমার বান্দা কি জানে যে তার একজন প্রতিপালক আছেন, যিনি অপরাধ ক্ষমা করেন অথবা অপরাধের কারণে শাস্তি দেন? আমি তাকে ক্ষমা করে দিলাম। অতঃপর সে অপরাধ না করে থাকল যতদিন আল্লাহ চাইলেন। সে আবার অপরাধ করল এবং বলল, হে আমার প্রতিপালক! আমি আবার আরেক অপরাধ করেছি, তুমি আমাকে ক্ষমা কর। তখন আল্লাহ বলেন, আমার বান্দা কি জানে যে তার একজন প্রতিপালক আছেন, যিনি অপরাধ ক্ষমা করেন অথবা অপরাধের কারণে শাস্তি দেন? আমি তাকে ক্ষমা করে দিলাম। সে যা ইচ্ছা করুক’ (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/২৩৩৩)।
ব্যাখ্যা: (فَلْيَفْعَلْ مَا شَآءَ) অর্থাৎ- এমন গুনাহ করতে থাকুক যার পর বিশুদ্ধ তাওবাহ্ থাকে। হাদীসটিতে আছে দ্বিতীয়বার পাপের কারণে প্রথমবারের বিশুদ্ধ তাওবার কোন ক্ষতি সাধন করবে না। বরং তাওবাহ্ তার বিশুদ্ধতার উপর অব্যাহত থাকবে এবং ব্যক্তি দ্বিতীয় অবাধ্যতা থেকে তাওবাহ্ করবে। আর মুনযিরী এমনটিই বলেছেন, (فَلْيَفْعَلْ مَا شَآءَ) এর অর্থ ব্যক্তির অবস্থা যখন এমন হবে যে, সে গুনাহ করবে অতঃপর তাওবাহ্ করবে এবং ক্ষমা প্রার্থনা করবে তখন সে যা ইচ্ছা তা যেন করে। কেননা যখনই সে গুনাহ করবে তখন তার তাওবাহ্ ও ক্ষমা প্রার্থনা তার ঐ গুনাহ মোচনের কারণ হবে, তখন গুনাহ তার ক্ষতি সাধন করবে না। ব্যক্তি গুনাহ করবে, অতঃপর ঐ গুনাহ থেকে অন্তর দ্বারা ক্ষমা প্রার্থনা না করে শুধু মৌখিকভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করবে। অতঃপর গুনাহতেই আবার লিপ্ত হবে নিশ্চয়ই এ বাক্য দ্বারা তা উদ্দেশ্য নয়। কেননা এ ধরনের তাওবাহ্ মিথ্যাবাদীদের তাওবাহ্।
‘উবায়দুল্লাহ মুবারকপূরী বলেন, আমি বলব, (فَلْيَفْعَلْ مَا شَآءَ) অর্থাৎ- সে যা ইচ্ছা তাই করুক। এ বাণীর অর্থ অনেকের কাছে জটিল হয়ে পড়েছে যেমননিভাবে হাত্বিব বিন বালতা‘আহ্-এর হাদীসে উল্লেখিত বাণীর অর্থ জটিল অনুভূত হয়েছে। কেননা বাণীটির বাহ্যিক রূপ দেখে মনে হচ্ছে বদর যুদ্ধে অংশ গ্রহণকারীদের জন্য প্রত্যেক ধরনের ‘আমল বৈধ এবং ‘আমলসমূহ থেকে তারা যা চায় তা তাদের ইচ্ছাধীন অথচ তা নিষিদ্ধ। এ সম্পর্কে কয়েকভাবে উত্তর দেয়া হয়েছে। আর সে উত্তরসমূহ থেকে ফাওয়ায়িদ গ্রন্থের ১৬ পৃষ্ঠাতে যা বলেছেন, তা এই নিশ্চয়ই এটা এমন এক সম্প্রদায়কে সম্বোধন যাদের ব্যাপারে আল্লাহ জেনেছেন যে, নিশ্চয়ই তারা তাদের ধর্ম থেকে আলাদা হবে না বরং তারা ইসলামের উপর মারা যাবে তবে কখনো কখনো তারা খারাপ কাজে জড়িত হবে যেমন অন্যান্যরা মন্দ গুনাহের কাজে জড়িত হয়ে থাকে। তবে আল্লাহ তাদেরকে গুনাহের উপর স্থায়ীভাবে ছেড়ে রাখবেন না। বরং তাদেরকে খাঁটি তাওবাহ্ করা, ক্ষমা প্রার্থনা করা এবং পুণ্য কাজ করার তাওফীক দিবেন যা ঐ গুনাহের প্রভাবকে মুছে দিবে। আর এ ব্যাপারে তাদেরকে নির্দিষ্ট করা হয়েছে অন্যদেরকে নয়, কেননা এটি তাদের মাঝে সুনিশ্চিত হয়ে গেছে। তাদেরকে ক্ষমা করে দেয়া হয়েছে আর তাদের মাধ্যমে সম্পাদিত হয় এমন উপকরণসমূহ দ্বারা অর্জিত ক্ষমা এ ক্ষমা থেকে বাধা দিতে পারবে না যে, তা ক্ষমার প্রতি নির্ভরশীল হয় ফরযসমূহ নষ্ট করে দেয়ার দাবী করে না। নির্দেশসমূহের সম্পাদনের উপর স্থায়িত্ব হওয়া ছাড়াই যদি ক্ষমা অর্জন হত তাহলে অবশ্যই তারা এরপর সালাত, সিয়াম, হজ, যাকাত ও জিহাদের প্রতি প্রয়োজনমুখী হত না, অথচ এটা অসম্ভব গুনাহের পর সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ওয়াজিব হল তাওবাহ্ করা। সুতরাং ক্ষমার শামিল ক্ষমার উপকরণসমূহ নষ্ট করে দেয়াকে আবশ্যক করে না। এর দৃষ্টান্ত হল, অন্য হাদীসে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর (বান্দা গুনাহ করে অতঃপর বলে হে আমার প্রভু আমি গুনাহ করেছি, সুতরাং তুমি আমাকে তা ক্ষমা কর, অতঃপর আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দেন) এ উক্তি। আর এ হাদীসে আছে, (قد غفرت لعبدى فليعمل ما شاء) অর্থাৎ- ‘‘আমি আমার বান্দাকে ক্ষমা করে দিলাম, সুতরাং সে যা চায় তা করুক।’’ অত্র হাদীসে আল্লাহর তরফ থেকে বান্দাকে হারাম ও অপরাধে লিপ্ত হওয়ার জন্য অনুমতি দেয়া হয়নি।
হাদীসটি কেবল ঐ ব্যাপারে প্রমাণ বহন করে যে, বান্দাকে ততক্ষণ পর্যন্ত ক্ষমা করে দেয়া হবে যতক্ষণ সে গুনাহ করার পর তাওবাহ্ করতে থাকবে। আর এ বান্দাকে এ ক্ষমার ব্যাপারে নির্দিষ্ট করার কারণ হল, আল্লাহ এ বান্দার ব্যাপারে জেনে নিয়েছেন যে, সে কোন গুনাহের উপর স্থায়ী হবে না। বরং যখন সে পাপ করবে তখনই তাওবাহ্ করবে। এমনিভাবে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যাদেরকে জান্নাতের সুসংবাদ দিয়েছেন অথবা খবর দিয়েছেন যে, তাকে ক্ষমা করে দেয়া হয়েছে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর এ ধরনের উক্তি থেকে ঐ সাহাবী বা অন্য কোন সাহাবী এ ধরনের মনে করেননি যে, তাকে তার গুনাহ এবং অবাধ্যতা ক্ষমা করে দেয়া হয়েছে এবং ওয়াজিবসমূহ ছেড়ে দেয়ার ব্যাপারে তার প্রতি উদারতা প্রকাশ করা হয়েছে। বরং এ সুসংবাদ পাওয়ার পরে পূর্বাপেক্ষা চেষ্টা, সাধনা, সতর্কতা ও ভয়ে আরো বেশি কঠোর ছিল। যেমন জান্নাতের সংবাদ প্রাপ্ত দশজন। আর এদের মাঝে আবূ বাকর ছিলেন অধিক সতর্ক ও ভয়কারী, এমনিভাবে ‘উমার (রাঃ)-ও ছিলেন। কারণ তারা জানতেন সাধারণ সুসংবাদ কিছু শর্ত এবং মরণ অবধি সেগুলোর উপর স্থায়ী হওয়ার দ্বারা গন্ডিবদ্ধ এবং সেগুলোর প্রতিবন্ধকসমূহ থেকে বিরত থাকা। তাদের কেউ এ ক্ষেত্রে কর্মে স্বেচ্ছাচারিতার ব্যাপারে অনুমতি প্রদান বুঝেননি।
আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে দ্বীনের সঠিক বুঝ দান করুন। তিনি আমাদের প্রতি রাগান্বিত না হয়ে ক্ষমা দৃষ্টিতে রহমত দ্বারা আচ্ছাদিত করুন, আমীন।