’আবদুল্লাহ ইবনু ’আমর ইবনুল ’আস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ «إِنَّ الْمُقْسِطِينَ عِنْدَ اللَّهِ عَلَى مَنَابِرَ مِنْ نُورٍ عَنْ يَمِينِ الرَّحْمَنِ وَكِلْتَا يَدَيْهِ يمينٌ الذينَ يعدِلُونَ فِي حُكمِهم وأهليهم وَمَا ولُوا» নিশ্চয়ই সত্যনিষ্ঠ বিচারক আল্লাহ তা’আলার নিকট তাঁর ডানপাশে নূরের মিম্বারের উপর অবস্থান করবে। যদিও আল্লাহ তা’আলার উভয় হাতই ডান (কল্যাণকর)। তারা হলো সে সমস্ত বিচারক- যারা তাদের বিচারালয়ে, নিজেদের পরিবার-পরিজনদের মাঝে এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় ন্যায় ও ইনসাফ কায়িম করে। (মুসলিম হা/১৮২৭, নাসায়ী হা/৫৩৭৯, মিশকাত হা/৩৬৯০
ব্যাখ্যা: অত্র হাদীসে ন্যায় বিচারক গুণাবলী প্রদান করার সময় মহাগ্রন্থ আল কুরআন থেকে আয়াত উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘‘তোমরা ইনসাফ করবে, নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা ইনসাফকারীদের পছন্দ করেন।’’ (সূরা আল হুজুরাত ৪৯ : ১৫) অন্যত্র বলেন, ‘‘আর যারা অন্যায়কারী তারা তো জাহান্নামের ইন্ধন।’’ (সূরা আল জিন্ ৭২ : ১৫)
কাযী (রহঃ) বলেছেনঃ ‘মিম্বার’ শব্দটির বিভিন্ন ধরনের অর্থ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। হাদীসের বাহ্যিক শব্দ অনুযায়ী পৃথিবীর মতো বাস্তব মিম্বার; আবার কেউ কেউ বলেছেন রূপক অর্থে, অর্থাৎ সুউচ্চ স্থান। (শারহে মুসলিম ১২শ খন্ড, ১৮২৮)
‘‘আল্লাহর ডান দিকে থাকবে’’ এর দ্বারা আল্লাহ তা‘আলার নিকট ন্যায়বিচারক শাসকের মর্যাদা ও উচ্চ আসন বুঝানো হয়েছে। কেননা যে ব্যক্তি মর্যাদাবান হয় সে ডান পাশে থাকে।
‘‘আল্লাহ তা‘আলার উভয় হাতই ডান’’ একটি সন্দেহ নিরসনের জন্য এ কথা ব্যবহার করা হয়েছে। যাতে কেউ মনে না করে বাম হাতের বিপরীত ডান হাত উদ্দেশ্য। কেননা বাম হাত ডান হাতের তুলনায় একটু দুর্বল হয়। অথচ আল্লাহ তা‘আলা সকল দুর্বলতা ও অসম্পূর্ণতা থেকে পবিত্র।
সুতরাং আমরা সাধারণভাবে বিশ্বাস করব আল্লাহ তা‘আলার হাত রয়েছে। তার পদ্ধতি বা কেমন তা আমরা জানব না- এটাই আহলুস্ সুন্নাহ্ ওয়াল জামা‘আতের অভিমত। (মিরকাতুল মাফাতীহ, শারহে মুসলিম ১২শ খন্ড, ১৮২৭)
নেতার সাথে দুজন গোপন পরামর্শদাতা থাকে :
আবূ সা’ঈদ আল খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আল্লাহ তা’আলা যাঁকে নবী অথবা খলীফাহ্ নিযুক্ত করে প্রেরণ করেন, তখন তাঁর জন্য দু’জন অদৃশ্য পরামর্শদাতা থাকে। এক পরামর্শদাতা তাকে সর্বদা সৎ ও ন্যায়সঙ্গত কাজ করার উৎসাহ-অনুপ্রাণিত করে। আর অপর পরামর্শদাতা তাকে অন্যায় ও অসৎকাজের প্রতি উৎসাহ-উদ্দীপনা দেয়। আর নিষ্পাপ থাকবে সে ব্যক্তি, যাকে আল্লাহ তা’আলা রক্ষা করবেন। (বুখারী হা/৭১৯৮, নাসায়ী হা/৪২০২, আহমাদ হা/১১৩৪২, ছহীহুল জামি‘হা/৫৫৭৯, মিশকাত হা/৩৬৯১)
ব্যাখ্যা: উপরোক্ত হাদীসের ব্যাখ্যায় হাদীস বিশারদগণ বিভিন্ন ধরনের মতামত উপস্থাপনা করেছেন। ‘‘দুই গোপন পরামর্শদাতা’’ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো মালাক (ফেরেশতা) এবং শায়ত্বন। এরা উভয়ে মানুষের মাঝে থাকে। মালাক ভালো কাজের আদেশ দেয়। আর পক্ষান্তরে শায়ত্বন মন্দ কাজ করার পরামর্শ দেয় এবং নিকৃষ্ট কাজ করার জন্য উৎসাহিত করে। (মিরকাতুল মাফাতীহ)
কিরমানী (রহঃ) বলেছেনঃ (بِطَانَتَانِ) দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, নাফসে আম্মারাহ্, নাফ্সে লাওয়ামাহ্ যা উৎসাহিত করে ভালো কাজের উপরে। যখন উভয়ের মাঝে পাওয়া যাবে ফেরেশতার শক্তি এবং পশুর শক্তি। ত্ববারী (রহঃ) বলেছেনঃ পরামর্শদাতা হলো অভিভাবক এবং একনিষ্ঠ বন্ধু। (ফাতহুল বারী ১৩শ খন্ড, হাঃ ৭১৯৮)
অপর হাদীসে এসেছে, ’আয়িশাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আল্লাহ তা’আলা যখন কোনো শাসকের কল্যাণ কামনা করেন, তখন তার জন্য একজন ন্যায়নিষ্ঠ পরামর্শদাতার (পরিচালনা পরিষদবর্গের) ব্যবস্থা করে দেন। তবে শাসক যদি (আল্লাহর কথা) ভুলে যায়, তখন পরামর্শদাতা তা স্মরণ করিয়ে দেয়। আর শাসক যদি স্মরণ রাখে, তাহলে পরামর্শদাতা তাকে সাহায্য-সহযোগিতা করে। আর যদি আল্লাহ তা’আলা কোনো শাসকের সাথে এর বিপরীত (তথা অকল্যাণ) কিছু করতে ইচ্ছা পোষণ করেন, তখন তার জন্য এমন একজন পরামর্শদাতার ব্যবস্থা করে দেন। যদি শাসক (আল্লাহর হুকুম-আহকাম) ভুলে যায়, তাহলে পরামর্শতাদা তা স্মরণ করিয়ে দেয় না। আর যদি শাসক স্মরণ করেন, তাহলেও পরামর্শদাতা তাকে সহযোগিতা করে না। আবূ দাঊদ হা/২৯৩২, নাসায়ী হা/৪২০৪, আহমাদ হা/২৪৪১৪, ছহীহুল জামি‘ হা/৩০২, মিশকাত হা/৩৭০৭
নেতাদের জন্য দুর্দশা :
আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, দুর্দশা শাসকদের জন্য, দুর্দশা সমাজপতিদের জন্য ও দুর্দশা আমানতদারদের জন্য। অনেক লোক কিয়ামতের দিন অবশ্যই কামনা করবে, যদি তাদের কপালের চুল ধ্রুবতারার সাথে বেঁধে দেয়া হত, আর তারা আকাশমন্ডলী ও জমিনের মাঝে ঝুলিয়ে রাখা হতো, তবুও তাদেরকে সে সব নেতৃত্ব না দেয়া হতো।
ইমাম আহমাদ (রহঃ)-ও হাদীসটি বর্ণনা করেন, যদি তাদের কপালের কেশগুচ্ছ ধ্রম্নবতারার সাথে বেঁধে দেয়া হত আর তারা আকাশমন্ডলী ও জমিনের মাঝে ঝুলিয়ে রাখা হতো, তবুও উত্তম হতো যদি তাদেরকে কোনো কাজের নেতৃত্ব দেয়া না হত। (আহমাদ ৮৬২৭, মিশকাত হা/ ৩৬৯৮)
নির্বোধ ব্যক্তির নেতৃত্ব থেকে পানহ চাওয়া উচিৎ :
কা’ব ইবনু ’উজরাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বলেছেনঃ নির্বোধ লোকেদের নেতৃত্ব থেকে আমি তোমাকে আল্লাহ তা’আলার হিফাযাতে অর্পিত করলাম। তিনি (কা’ব ) বললেনঃ হে আল্লাহর রসূল! এটা কিরূপে হবে? তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেনঃ শীঘ্রই আমার পরে বিভিন্ন যুগে তাদের (নির্বোধ ও যালিমরূপে আমীর ও শাসক) আবির্ভূত হবে আর যে ব্যক্তি তাদের সান্নিধ্যে থাকবে এবং তাদের মিথ্যাকে সত্য বলে স্বীকৃতি দিবে এবং তাদের অন্যায় ও জুলুমের সহযোগিতা করবে, সে আমার দলভুক্ত নয় এবং তাদের সাথে আমারও কোনো সম্পর্ক নেই। তারা আমার হাওযে কাওসারে* আসতে পারবে না। আর যে তাদের নিকট যাবে না এবং তাদের মিথ্যাকে সত্যায়িত করবে না এবং তাদের অন্যায়ের কাজে সাহায্য-সহযোগিতা করবে না। তারাই হবে আমার দলভুক্ত। আর আমিও তাদের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করি। আর তারা হাওযে কাওসারে আমার নিকট আগমন করবে। (নাসায়ী হা/৪২০৭, তিরমিযী হা/৬১৪, মিশকাত হা/ ৩৭০০)
উল্লেখিত হাদীসে سُفَهَاءِ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো ঐ সকল নির্বোধ লোক যারা ‘ইলম ও ‘আমলের দিক থেকে অজ্ঞ। ইমাম ত্বীবী (রহঃ) বলেনঃ سُفَهَاءِ বলা হয় ঐ সকল লোকেদেরকে যারা অল্প জ্ঞানের অধিকারী।
অল্প জ্ঞানের অধিকারী ব্যক্তিকে বলা হয়। আর এ কারণে যখন কোনো ব্যক্তি নেতৃত্ব দানের ক্ষেত্রে নিজের যোগ্যতা প্রকাশে অপারগ হয়। তখন তার ক্ষেত্রে বলা হয়ে থাকে যে, সে নিজের মত প্রকাশের ক্ষেত্রে নির্বোধতার পরিচয় দিয়েছে। মোট কথা হচ্ছে, السَّفِيهُ অজ্ঞ ব্যক্তিকে বলা হয়। তাই রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অন্য এক হাদীসে বলেছেন যে, আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন ‘আলিমদের মৃত্যুর মাধ্যমে ‘ইলম উঠিয়ে নিবেন। অতঃপর লোকেরা অজ্ঞদেরকে নিজেদের নেতা হিসেবে নির্ধারণ করবে। (মিরকাতুল মাফাতীহ)
মূর্খ নেতার সন্নিকটে থাকা ব্যক্তি ফিতনায় পর্যবসিত হয় :
ইবনু ’আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে গ্রামে-গঞ্জে বসবাস করে, সে অচেতন (সামাজিক শিক্ষা-শিষ্টাচার বহির্ভূত) হয়। আর যে শিকারের পিছনে দৌড়ায়, সে উদাসীন হয়। আর যে শাসকের সন্নিকটে থাকে, সে ফিতনায় পর্যবসিত হয় (ঝামেলায় পড়ে)।
আর আবূ দাঊদ-এর বর্ণনাতে আছে, যে শাসকের সান্নিধ্যে থাকে, সে ফিতনায় নিপতিত হয়। আর যখনই যে ব্যক্তি শাসকের যত নিকটবর্তী হয়, সে ততই আল্লাহ থেকে দূরে চলে যায়। আবূ দাঊদ হা/২৮৫৯, নাসায়ী হা/৪৩০৯, তিরমিযী হা/২২৫৬, আহমাদ হা/৩৩৬২, ছহীহুল জামি‘ হা/৬২৯৬, মিশকাত হা/ ৩৭০১)
ইমাম কাযী (রহঃ) বলেনঃ লোক কঠোর হয় যখন তার অন্তর শক্ত ও কঠোর হয়। ফলে তার অন্তর সৎ আচরণ ও আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখার জন্য নরম হয় না। আর এটা অধিকাংশ সময় গ্রামের অধিবাসীদের ক্ষেত্রে হয়ে থাকে। কারণ তারা ‘আলিম-‘উলামাদের সান্নিধ্যে থেকে বঞ্চিত থাকে এবং লোকেদের সাথে তাদের চলাফেরা কম হওয়ার কারণে ফলে তাদের স্বভাব চরিত্র হিংস্র প্রাণীর স্বভাব চরিত্রের মতো হয়ে যায়।
ইমাম মুযহির বলেনঃ যে ব্যক্তি গ্রামে বসবাস নিজের জন্য আবশ্যক করে নেয় বিশেষ করে সে জামা‘আত ও জুমু‘আর সালাতে উপস্থিত হতে পারে না এবং ‘আলিমদের মাজলিসেও উপস্থিত হতে পারে না। আর এভাবে সে নিজের ওপর জুলুম করে। যে ব্যক্তি আনন্দ ফূর্তি ও খেল-তামাশার জন্য শিকারে অভ্যস্ত হয় সে অলস হয়, কেননা আনন্দ ফূর্তি ও খেল-তামাশা মৃত অন্তরের পক্ষ থেকে সৃষ্টি হয়। আর যে ব্যক্তি শক্তি সঞ্চারণের উদ্দেশে শিকার করবে তার জন্য তা বৈধ, কেননা কিছু সাহাবী শিকার করেছেন। (মিরকাতুল মাফাতীহ)