আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছা.) বলেন, “ لَيْسَ بَيْنَ الْعَبْدِ وَالشِّرْكِ إِلاَّ تَرْكُ الصَّلاَةِ فَإِذَا تَرَكَهَا فَقَدْ أَشْرَكَ ” ‘(মুমিন) বান্দা ও শিরকের মধ্যে পার্থক্য হলো সালাত বর্জন করা। সুতরাং যে ব্যক্তি সালাত ত্যাগ করলো, সে অবশ্যই শিরক করলো’ (ইবনু মাজাহ হা/১০৮০)। অন্যত্র জাবির (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, بَيْنَ الْكُفْرِ وَالإِيمَانِ تَرْكُ الصَّلاَةِ ‘কুফর ও ঈমানের মধ্যে পার্থক্য হলো সালাত ত্যাগ করা’ (তিরমিযী হা/২৬১৮, ইবনু মাজাহ হা/১০৭৮)।
এখানে উল্লেখ্য যে, তাওহীদ তথা কালেমা পাঠের মাধ্যমে সাক্ষ্য দিয়ে মুমিন হয়। এটা ঈমানের ক্ষীণ নূর। কিন্তু সালাতের মাধ্যমে মানুষের ঈমানের নূর বেড়ে যায় এবং আত্মা প্রশান্তি অনুভব করে। কুফর ও ঈমানের মধ্যে পার্থক্য এবং মুমিন ও শিরকের মধ্যে পার্থক্য হলো সালাত। এমন অনেক মানুষ আছে যারা নামে মুমিন দাবী করে আবার জুমআর সালাত ব্যতীত অন্য পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করে না। এরা প্রবৃত্তির অনুসারী। আর প্রবৃত্তির অনুসারী শিরকে লিপ্ত হয়। যেমন- আত্মপ্রচার অথবা রিয়া প্রদর্শন বা লোক দেখানো শিরক। এদেরকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।
সালাতের মাধ্যমে আল্লাহর প্রিয় বান্দা হওয়া সম্ভব :
শারঈ বিধানে সালাত সৎকর্মগুলোর মধ্যে অন্যতম। সালাত হ’ল আল্লাহ তা‘আলা নিকট অধিক প্রিয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَأَقِيمُوا الصَّلَاةَ وَآتُوا الزَّكَاةَ وَارْكَعُوا مَعَ الرَّاكِعِينَ ‘আর তোমরা ছালাত কায়েম করো, যাকাত প্রদান করো এবং রুকূকারীদের সাথে রুকূ‘ করো’ (বাক্বারাহ ২/৪৩)। আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, আল্লাহ তা’আলা বলেন, ‘যে ব্যক্তি আমার কোন বন্ধুকে শত্রু ভাবে আমি তার সাথে যুদ্ধ ঘোষণা করি। আমি আমার বান্দার ওপর যা কিছু (’আমল) ফরয করেছি; তা দ্বারা আমার সান্নিধ্য অর্জন করা আমার নিকট বেশী প্রিয় অন্য কিছু (’আমল) দিয়ে সান্নিধ্য অর্জনের চাইতে। আর আমার বান্দা সর্বদা নফল ’ইবাদাতের মাধ্যমে আমার নৈকট্য হাসিল করে।
পরিশেষে আমি তাকে ভালবাসি এবং আমি যখন তাকে ভালবাসি- আমি হয়ে যাই তার কান, যা দিয়ে সে শুনে। আমি হয়ে যাই তার চোখ, যা দিয়ে সে দেখে। আমি হয়ে যাই তার হাত, যা দিয়ে সে ধরে (কাজ করে)। আমি হয়ে যাই তার পা, যা দিয়ে চলাফেরা করে। সে যদি আমার কাছে চায়, আমি তাকে দান করি। সে যদি আমার কাছে আশ্রয় চায়, আমি তাকে আশ্রয় দেই। আর আমি যা করতে চাই, তা করতে আমি মু’মিন বান্দার রূহ কবয করার মতো ইতস্তত করি না। কেননা মু’মিন (স্বাভাবিকভাবে) মৃত্যুকে অপছন্দ করে, আর আমি অপছন্দ করি তাকে অসন্তুষ্ট করতে। কিন্তু মৃত্যু তার জন্য অত্যাবশ্যকীয়। (বুখারী হা/৬৫০২; মিশকাত হা/২২৬৬)।
বান্দার সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো আমার (আল্লাহর) আনুগত্য ও বশ্যতা স্বীকার করে যেহেতু সে এমন কোন কিছু শুনে না যা আমি অপছন্দ করি, এমন কিছু দেখে না যা আমার অপছন্দনীয়, এমন কিছু ধরে না যা আমি অপছন্দ করি, এমন দিকে পা বাড়ায় না যা আমি অপছন্দ করি।
বিচার দিবসে সর্বপ্রথম সালাতের হিসেব হবে :
আল্লাহ সূবহানাহু ওয়া তা‘আলা বলেন, مَا سَلَكَكُمْ فِيْ سَقَر، قَالُوْا لَمْ نَكُ مِنَ الْمُصَلِّيْنَ، ‘কিসে তোমাদেরকে সাকার (জাহান্নামে) নিক্ষেপ করেছে? তারা বলবে, আমরা মুছল্লী ছিলাম না’ (মুদাসসির ৭৪/৪২-৪৩)।
কিয়ামতের মাঠে সর্বপ্রথম ছালাতের হিসাব গ্রহণ করা হবে। আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,
إِنَّ أَوَّلَ مَا يُحَاسَبُ بِهِ الْعَبْدُ الْمُسْلِمُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ الصَّلاَةُ الْمَكْتُوبَةُ فَإِنْ أَتَمَّهَا وَإِلاَّ قِيلَ انْظُرُوا هَلْ لَهُ مِنْ تَطَوُّعٍ فَإِنْ كَانَ لَهُ تَطَوُّعٌ أُكْمِلَتِ الْفَرِيضَةُ مِنْ تَطَوُّعِهِ ثُمَّ يُفْعَلُ بِسَائِرِ الأَعْمَالِ الْمَفْرُوضَةِ مِثْلُ ذَلِكَ.
‘কিয়ামতের দিন মুসলিম বান্দার সর্বপ্রথম ফরয ছালাতের হিসাব নেয়া হবে। যদি সে তা পূর্ণরূপে আদায় করে থাকে, তবে তা ভালো। অন্যথায় বলা হবে, দেখো তার কোন নফল ছালাত আছে কি না? যদি তার নফল ছালাত থাকে, তবে তা দিয়ে তার ফরয ছালাত পূর্ণ করা হবে। অতঃপর অন্যান্য সব ফরয আমলের ব্যাপারেও অনুরূপ ব্যবস্থা করা হবে’(ত্বাবারাণী, মু‘জামূল আওসাত্ব হা/১৮৫৯; সিলসিলা ছহীহাহ হা/১৩৫৮)।
ঈমানের পরে সালাত কায়েম করা :
ইসলামে প্রবেশকারী মুসলমান আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের স্বীকৃতি প্রদানের পরেই তার ওপর ছালাত ও যাকাতের বিধান অপরিহার্য। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেছেন, أُمِرْتُ أَنْ أُقَاتِلَ النَّاسَ حَتَّى يَشْهَدُوا أَنْ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا رَسُولُ اللَّهِ ، وَيُقِيمُوا الصَّلاَةَ، وَيُؤْتُوا الزَّكَاةَ، ‘আমি লোকদের সাথে যুদ্ধ করতে আদিষ্ট হয়েছি, যে পর্যন্ত না তারা সাক্ষ্য দেয় যে, আল্লাহ ব্যতীত কোন (সত্য) উপাস্য নেই এবং মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল। আর তারা ছালাত কায়েম করে ও যাকাত আদায় করে’(বুখারী হা/২৫; মিশকাত হা/১২; ইবনু হিব্বান হা/২১৯; দারাকুৎনী হা/৯১০)। সুতরাং যে ব্যক্তি আল্লাহর একত্ববাদ ও মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর রিসালাতের সাক্ষ্য দেয়ার পর সালাত কায়িম করবে ও যাকাত আদায় করবে তার রক্ত পবিত্র। তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা যাবে না। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে সালাত পরিত্যাগ করবে তাকে শাস্তি স্বরূপ মৃত্যুদণ্ড দেয়া যাবে। অনুরূপভাবে সালাত পরিত্যাগকারী কাফির বিধায় তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া যাবে।
ইচ্ছাকৃতভাবে সালাত ত্যাগকারী দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হয় :
ইচ্ছাকৃতভাবে সালাত তরককারী অথবা ছালাতের ফরযিয়াতকে অস্বীকারকারী ব্যক্তি কাফির ও জাহান্নামী। ঐ ব্যক্তি ইসলাম হ’তে বহিষ্কৃত। মু‘আয (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, وَلاَ تَتْرُكَنَّ صَلاَةً مَكْتُوبَةً مُتَعَمِّداً فَإِنَّ مَنْ تَرَكَ صَلاَةً مَكْتُوبَةً مُتَعَمِّداً فَقَدْ بَرِئَتْ مِنْهُ ذِمَّةُ اللَّهِ ‘ইচ্ছাকৃত ভাবে কখনও ফযর সালাত পরিত্যাগ করো না। কেননা ইচ্ছাকৃত ভাবে যে ব্যক্তি ফরয সালাত ত্যাগ করে, আল্লাহ তা‘আলা তার ওপর থেকে দায়িত্ব উঠিয়ে নেন’ (আহমাদ হা/২২১২৮; মিশকাত হা/৬১)।
অন্যত্র বলেন, لَا تَتْرُكْ صَلَاةً مَكْتُوبَة مُتَعَمدا فَمن تَركهَا مُتَعَمدا فقد بَرِئت مِنْهُ الذِّمَّةُ ‘ইচ্ছাকৃত ভাবে ফরয সালাত ত্যাগ করবে না। যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃত ভাবে ফরয সালাত ত্যাগ করবে, তার ওপর থেকে ইসলাম প্রদত্ত নিরাপত্তা উঠে যাবে’(ইবনু মাজাহ, মিশকাত হা/৫৮০; ছহীহুল জামি‘ হা/৭৩৩৯)।
সালাত ত্যাগ করা যাবতীয় নেক কাজ ত্যাগ করার শামিল। সালাত ত্যাগ করলে মানুষ ইহকাল ও পরকালের যাবতীয় কল্যাণ হতে বঞ্চিত থাকবে।
ইচ্ছাকৃতভাবে সালাত ত্যাগ করা কুফরী :
সাধারণভাবে ছালাত তরক করাকে হাদীছে ‘কুফরী’ হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে। জাবির (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘ بَيْنَ الْعَبْدِ وَبَيْنَ الْكُفْرِ تَرْكُ الصَّلاَةِ. ‘(মুমিন) বান্দা ও কুফরীর মধ্যে পার্থক্য হ’ল ছালাত পরিত্যাগ করা’(মুসলিম, মিশকাত হা/৫৬৯; আবূদাউদ হা/৪৬৭৮; তিরমিযী হা/২৬২০; ইবনু মাজাহ হা/১০৭৪)।
ছাহাবায়ে কেরামও একে ‘কুফরী’ হিসাবে গণ্য করতেন। আব্দুল্লাহ বিন শাক্বীক্ব (রহঃ) বলেন, كَانَ أَصْحَابُ مُحَمَّدٍ صلى الله عليه وسلم لاَ يَرَوْنَ شَيْئًا مِنَ الأَعْمَالِ تَرْكُهُ كُفْرٌ غَيْرَ الصَّلاَةِ. ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সাহাবীগণ সালাত ছাড়া অন্য কোন ‘আমল পরিত্যাগ করাকে কুফরী বলে মনে করতেন না’(তিরমিযী হা/২৬২২; মিশকাত হা/৫৭৯; ছহীহ আত-তারগীব হা/৫৬৪)।
তারা নিঃসন্দেহে জাহান্নামী। তবে অস্বীকারকারী কাফিরগণের ন্যায় ইসলাম থেকে খারিজ নয় বা চিরস্থায়ী জাহান্নামী নয়। কেননা এই প্রকারের মুসলমানেরা কর্মগতভাবে কাফির হ’লেও বিশ্বাসগতভাবে কাফির নয়। বরং খালেছ অন্তরে পাঠ করা কালেমার বরকতে এবং কবীরা গুণাহগারদের জন্য শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর শাফা‘আতের ফলে শেষ পর্যায়ে এক সময় তারা জান্নাতে ফিরে আসবে (মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৫৫৭৩-৭৪; তিরমিযী, ইবনু মাজাহ, মিশকাত হা/৫৫৯৮-৫৬০০)। তবে তারা সেখানে ‘জাহান্নামী’ (اَلْجَهَنَّمِيُّوْنَ) বলেই অভিহিত হবে (বুখারী হা/৭৪৮০; মিশকাত হা/৫৫৮৪)।
সালাতকে মুসলিম ও কাফিরের মাঝে সুস্পষ্ট পার্থক্যকারী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ইসলামে একমাত্র সালাতকেই সুস্পষ্ট পার্থক্য নিরূপণকারী সাব্যস্ত করা হয়েছে। বুরায়দাহ্ (রাঃ)হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, আমাদের ও তাদের মধ্যে যে প্রতিশ্রুতি রয়েছে, তা হলো সালাত। অতএব যে সালাত পরিত্যাগ করবে, সে (প্রকাশ্যে) কুফরী করলো (তিরমিযী হা/২৬২১, নাসায়ী হা/৪৬৩, ইবনু মাজাহ্ হা/১০৭৯ সহীহ আত্ তারগীব হা/৫৬৪, আহমাদ হা/২২৯৩৭)।
ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বাল-এর মতে, উপরোক্ত হাদীসের আলোকে সালাত বর্জনকারী কাফির। তবে সর্বসম্মতমতে সালাত বর্জনকারী কাফির হলেও মুসলিম মিল্লাতের বাইরে নয়। আল্লাহই প্রকৃত সত্য অবগত।
সালাত ব্যতীত এমন কোন ইবাদত নেই যে আল্লাহর নৈকট্য হাসিলে বিশেষ ভূমিকা রাখে। আল্লাহ সেজদাকারীকে অত্যন্ত পসন্দ করেন ও ভালবাসেন। সুতরাং আমরা আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের অর্ন্তভুক্ত হতে চাইলে রাতের সালাতের প্রতি গুরুত্বাপোপ করি ও বেশী বেশী সেজদাতে ক্ষমা প্রর্থণা করি। আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে দ্বীনের সঠিক বুঝ দান করুন, আমীন।