দরসে হাদীছ : বিজাতীয় সাদৃশ্যতা ত্যাগ করুন !

’আবদুল্লাহ ইবনু ’উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, «مَنْ تَشَبَّهَ بِقَوْمٍ فَهُوَ مِنْهُمْ» ‘যে ব্যক্তি কোন সম্প্রদায়ের সাদৃশ্য অবলম্বন করবে, সে ব্যক্তি (কিয়ামতের দিন) তাদের অন্তর্ভুক্ত হবে’ (আবূদাঊদ হা/৪০৩১; মিশকাত হা/৪৩৪৭ ‘পোষাক’ অধ্যায়)।

ব্যাখ্যাঃ ‘‘যে ব্যক্তি কোন সম্প্রদায়ের সাদৃশ্য গ্রহণ করবে’’-এর অর্থে আল মানাভী ও আলকামী বলেনঃ যে প্রকাশ্যে তাদের বেশ-ভূষা গ্রহণ করলো, পোশাক-পরিচ্ছদে তাদের জীবনাচার ও সংস্কৃতি এবং জীবনযাপনে তাদের কিছু কাজকর্ম গ্রহণ করলো। কারী বলেনঃ এর অর্থ হলো, যে তার নিজের পোশাক বা অন্য কিছুতে কাফির, ফাসিক, পাপিষ্ঠ, সূফী ইত্যাদি জাতির সাদৃশ্য অবলম্বন করে। কারী বলেন, ‘‘সে তাদের অন্তর্ভুক্ত’’- এ বাক্যাংশ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো সাদৃশ্য অবলম্বনকারীরা গুনাহ ও কল্যাণে সাদৃশ্য অবলম্বনকৃতদের অংশীদার হবে। আল কারী বলেনঃ যে ব্যক্তি নেককার ব্যক্তিদের সাথে সাদৃশ্য রাখে তারা সম্মানিত হবে যেভাবে নেককাররা সম্মানিত হন। আর যারা ফাসিকদের সাথে সাদৃশ্য রাখে তারা সম্মানিত হবে না। তবে তাদের ওপর যদি সম্মানিতদের নিদর্শন পরিয়ে দেয়া হয় তাহলে তারা সম্মানিত হবে কিন্তু বাস্তবে সে সম্মানের যোগ্য নয়।

শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়াহ্ (রহিমাহুল্লাহ) তাঁর ‘‘আস্ সিরাত আল মুসতাকিম’’ গ্রন্থে বলেন, ইমাম আহমাদ (রহিমাহুল্লাহ)-সহ অনেকেই এ হাদীস দ্বারা দলীল দেন যে, কাফির-মুশরিকদের সাদৃশ্য অবলম্বন করা হারাম। যেমনটা আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَمَنْ يَتَوَلَّهُمْ مِنْكُمْ فَإِنَّه مِنْهُمْ ‘‘আর তোমাদের মধ্যে যে তাদের সাথে বন্ধুত্ব করবে, সে নিশ্চয় তাদেরই একজন।’’ (সূরাহ্ আল-মায়িদাহ্ ৫ : ৫১)

এ কথার সম্পূরক কথা বলেছেন ‘আবদুল্লাহ ইবনু ‘আমর । তিনি বলেন, من بنى بأرض المشركين وصنع نيروزهم ومهرجانهم وتشبه بهم حتى يموت حشر معهم يوم القيامة ‘‘কেউ যদি মুশরিকদের দেশে বাড়ি নির্মাণ করে, তাদের নওরোয ও মেলায় অংশগ্রহণ করে এবং মৃত্যু পর্যন্ত তাদের সাথে সাদৃশ্য অবলম্বন করে তাহলে তাকে কিয়ামতের দিন তাদের (মুশরিকদের) সাথেই হাশর করা হবে।’’

মুসলিম যদি মুশরিকদের সাথে সাদৃশ্য অবলম্বন করে তাহলে সেটা তাকে কুফরীর দিকে নিয়ে যায়। তবে কেউ যদি সব কিছুতে মুশরিকদের সাধে সাদৃশ্য অবলম্বন না করে কিছু কিছু ক্ষেত্রে তাদের সাদৃশ্য অবলম্বন করে তাহলে যতটুকুতে সে সাদৃশ্য অবলম্বন করেছে ততটুকু দায়ই তার ওপর বর্তাবে। হোক সেটা কুফরী বা কোন সাধারণ গুনাহ কিংবা তাদের কোন নিদর্শন। এ হাদীস দ্বারা ‘আলিমগণ দলীল দিয়েছেন যে, অমুসলিমদের বেশ-ভূষার যে কোন কিছুই গ্রহণ করা মাকরূহ বা অপছন্দনীয়। তিরমিযীতে বর্ণিত অন্য হাদীসে এসেছে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ لَيْسَ مِنَّا مَنْ تَشَبَّهَ بِغَيْرِنَا ‘‘ঐ ব্যক্তি আমাদের দলভুক্ত নয় যে, আমাদের ছাড়া অন্যদের সাথে সাদৃশ্য অবলম্বন করে’’।

এ বিষয়ে পরিপূর্ণ কথা রয়েছে শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনু তায়মিয়াহ্ (রহিমাহুল্লাহ)-এর লেখা ‘‘আস্ সিরাত আল মুসতাকিম’’ গ্রন্থে ‘আল্লামা আল মানবী (রহিমাহুল্লাহ)-এর লেখা ‘‘ফাতহুল কদীর’’ গ্রন্থে এবং কাযী বাশীরুদ্দীন আল কান্নূজী (রহিমাহুল্লাহ)-এর গ্রন্থাবলীতে।

কাফেরদের সাদৃশ্যের প্রকৃত ব্যাখ্যা ও হুকুম :

রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি অন্য জাতির সাদৃশ্য অবলম্বন করে, সে তাদের দলভুক্ত গণ্য হবে’ (আবুদাঊদ হা/৪০৩১; মিশকাত হা/৪৩৪৭)। এর ব্যাখ্যায় ত্বীবী বলেন, এর দ্বারা চেহারায়, চরিত্রে ও পোষাকে সাদৃশ্য বুঝানো হয়েছে। তবে পোষাকে সাদৃশ্যই প্রধান’। মোল্লা আলী ক্বারী হানাফী বলেন, পোশাক ও অন্যান্য ক্ষেত্রে কাফিরদের সাথে কিংবা ফাসিক, পাপাচারী কিংবা ছূফী ও নেককার ব্যক্তিদের সাথে সাদৃশ্য রাখা, অর্থাৎ ভালো কিংবা খারাপ যে সকল মানুষের সাথে সাদৃশ্য রাখবে, সে তাদেরই দলভুক্ত হবে (মিরক্বাত হা/৪৩৪৭-এর ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য, ৭/২৭৮২)। মানাভী বলেন, তাদের মতে পোষাক পরিধান করা, তাদের পথে পরিচালিত হওয়া, পোষাকে ও কাজে তাদের সাদৃশ্য অবলম্বন করা (ফায়যুল ক্বাদীর ৬/১০৪, হা/৮৫৯৩-এর ব্যাখ্যা)। যেমন আব্দুল্লাহ বিন আমর ইবনুল ‘আছ (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) আমার পরিধানে হলুদ রংয়ের দু’টি পোষাক দেখে বললেন, ‘এগুলো কাফিরদের পোষাক। অতএব তুমি এসব পরবে না’ (মুসলিম হা/২০৭৭; মিশকাত হা/৪৩২৭)। অন্য বর্ণনায় রয়েছে, ‘তোমাদের কারো নিকট দু’টি কাপড় থাকলে সে যেন ঐগুলি পরেই ছালাত আদায় করে। আর একটিমাত্র কাপড় থাকলে সে যেন তা কোমরে বেঁধে নেয় এবং ইহূদীদের ন্যায় দু’কাঁধে ঝুলিয়ে না রাখে’ (আবুদাঊদ হা/৬৩৫; ইবনু খুযায়মা হা/৭৬৬)।

এক্ষণে কাফিরদের সাথে সাদৃশ্য অবলম্বন করাকে দু’ভাগে ভাগ করা যায়- ১. অবৈধ সাদৃশ্য। অর্থাৎ জেনেশুনে কাফিরদের এমন বিষয়ের সাথে সাদৃশ্য রাখা, যা তাদের ধর্ম-কর্মের সাথে সংশ্লিষ্ট এবং ইসলামী শরী‘আতে যার সমর্থন নেই। এরূপ সাদৃশ্য হারাম এবং ক্ষেত্রবিশেষে কবীরা গুনাহ। ২. বৈধ সাদৃশ্য। অর্থাৎ যা মৌলিকভাবে কাফেরদের গৃহীত রীতি-নীতি থেকে গৃহীত হয়নি। বরং মুসলমানরা পরিধান করে এবং তারাও করে’ (দ্র. সুহায়েল হাসান, কিতাবুস সুনান ওয়াল আছার ফিন নাহিয়ে আনিত তাশাববুহে বিল কুফফার ৫৮-৫৯ পৃ.)।

ইব্‌ন কাসির রাহিমাহুল্লাহ বলেন: “কোন মুসলিমের সুযোগ নেই কাফেরদের সামঞ্জস্য গ্রহণ করা, না তাদের ধর্মীয় উৎসবে, না মৌসুমি উৎসবে, না তাদের কোন ইবাদতে। কারণ আল্লাহ তাআলা এ উম্মতকে সর্বশেষ নবী দ্বারা সম্মানিত করেছেন, যাকে পরিপূর্ণ ও সর্বব্যাপী দীন দেয়া হয়েছে। যদি মূসা ইব্‌ন ইমরান জীবিত থাকত, যার উপর তাওরাত নাযিল হয়েছে; কিংবা ঈসা ইব্‌ন মারইয়াম জীবিত থাকত, যার উপর ইঞ্জিল নাযিল হয়েছে; তারাও ইসলামের অনুসারী হত। তারাসহ সকল নবী থাকলেও কারো পক্ষে পরিপূর্ণ ও সম্মানিত শরিয়তের বাইরে যাওয়ার সুযোগ থাকত না। অতএব মহান নবীর আদর্শ ত্যাগ করে আমাদের পক্ষে কীভাবে সম্ভব এমন জাতির অনুসরণ করা, যারা নিজেরা পথভ্রষ্ট, মানুষকে পথ ভ্রষ্টকারী ও সঠিক দীন থেকে বিচ্যুত। তারা বিকৃতি, পরিবর্তন ও অপব্যাখ্যা করে আসমানি ওহির কোন বৈশিষ্ট্য তাদের দীনে অবশিষ্ট রাখেনি। দ্বিতীয়ত তাদের ধর্ম রহিত, রহিত ধর্মের অনুসরণ করা হারাম, তার উপর যত আমল করা হোক আল্লাহ গ্রহণ করবেন না। তাদের ধর্ম ও মানব রচিত ধর্মের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। আল্লাহ যাকে চান সঠিক পথের সন্ধান দান করেন”।

ইব্‌নুল কায়্যিম জাওযি রাহিমাহুল্লাহ বলেন: “তাদেরকে তাদের কুফরি উৎসব উপলক্ষে শুভেচ্ছা জানানো সবার নিকট হারাম, যেমন বলা: “তোমার উৎসব সফল হোক”, “শুভ বড় দিন” অথবা এ জাতীয় অন্যান্য শব্দ, যা বর্তমান আমরা শুনতে পাই।এভাবে শুভেচ্ছা জানানোর ফলে যদিও সে কাফের হয় না, কিন্তু তার এ কর্ম হারাম কোন সন্দেহ নেই। কারণ প্রকারান্তরে এভাবে সে ক্রুশকে সেজদার প্রতি উদ্বুদ্ধ করছে! এ জাতীয় শুভেচ্ছা মদ্যপ, হত্যাকারী ও ব্যভিচারীকে শুভেচ্ছার জানানোর চেয়ে মারাত্মক। অথচ যে কবিরা গুনাহের জন্য শুভেচ্ছা জানাল, সে নিজেকে আল্লাহর শাস্তি ও গোস্বার জন্য প্রস্তুত করল”।

ইবনুল কাইয়্যিম (রহঃ) বলেন: যে ব্যক্তি কোন মানুষকে পাপকর্ম, বিদআত কিংবা কুফরির জন্য অভিনন্দন জানাবে সে নিজেকে আল্লাহর অসন্তুষ্টির মুখোমুখি করল। জালেমেরা ক্ষমতা লাভ করলে তাকওয়াবান আলেমগণ তাদেরকে শুভেচ্ছা জানানো থেকে বিরত থাকতেন। মূর্খ লোকেরা বিচারকের দায়িত্ব, শিক্ষকতার দায়িত্ব কিংবা ফতোয়া দেয়ার দায়িত্ব পেলে আল্লাহর শাস্তির ভয়ে কিংবা আল্লাহর কাছে তাদের মর্যাদা কমে যাওয়ার ভয়ে তারা তাদেরকে শুভেচ্ছা জানানো থেকে বিরত থাকতেন। আর যদি কোন আলেম পরীক্ষার মুখোমুখি হন এবং জালেমের অনিষ্ট থেকে নিরাপদ থাকার জন্য তাদেরকে শুভেচ্ছা জানিয়ে থাকেন; তিনি তাদের কাছে গিয়ে যা কিছু বলেন ভাল কথা বলেন, তাদের জন্য তাওফিকের দোয়া করেন; তাতে কোন অসুবিধা নেই।”[আহকামু আহলিয যিম্মাহ (১/৪৪১ ৪৪২)]

জীবন থেকে হারিয়ে যাবে গণনাকৃত একটি বছর,

মুসাফীরের ক্লান্ত জীবন ক্রমে ক্রমে হচ্ছে কছর।

থার্টিফার্স্ট নাইট হতে পারে আপনার জীবনের লাস্ট নাইট। তাই অমুসলিমদের অনুকরণে এসব দিবস পালন করা সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ। এগুলি স্রেফ জাহেলিয়াত এবং বিজাতীয় সংস্কৃতি মাত্র। এসব অনুষ্ঠান সমাজে অশ্লীলতা ও বেহায়াপনা প্রসারের অন্যতম মাধ্যম। আর আল্লাহ প্রকাশ্য ও গোপন সকল প্রকার অশ্লীলতার নিকটবর্তী হ’তে নিষেধ করেছেন (আন‘আম ৬/১৫১)।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

loader-image

Scroll to Top