দরসে হাদীস : সর্বনিম্ন শিরক থেকেও বেঁচে থাকুন!

তারিক বিন শিহাব হতে বর্ণিত হাদীছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ

«دخل الجنة رجل فى ذباب ودخل النار رجل فى ذباب قالوا وكيف ذلك يا رسول الله قال: مر رجلان على قوم لهم صنم لا يجوزه أحد حتى يقرب له شيئا فقالوا لاحدهما: قرب قال: ليس عندي شئ أقرب، قالوا له: قرب ولو ذباب فقرب ذباب فخلوا سبيله فدخل النار وقالوا للآخر: قرب، قال ما كنت أقرب شيئا دون الله عز وجل فضربوا عنقه فدخل الجنة»

‘‘এক ব্যক্তি একটি মাছির কারণে জান্নাতে প্রবেশ করেছে। আর এক ব্যক্তি একটি মাছির কারণে জাহান্নামে গিয়েছে। সাহাবীগণ বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! এটি কিভাবে হলো? তিনি বললেনঃ দু’জন লোক এমন একটি গোত্রের নিকট দিয়ে যাচ্ছিল, যাদের একটি মূর্তি ছিল। উক্ত মূর্তির জন্য কোন কিছু উৎসর্গ না করে কেউ সে স্থান অতিক্রম করতে পারতোনা। উক্ত কওমের লোকেরা দু’জনের একজনকে বললো, ‘মূর্তির জন্য তুমি কিছু কুরবানী করো’। সে বললো, কুরবানী দেয়ার মত আমার কিছুই নেই। তারা বলল, অন্ততঃ একটি মাছি হলেও কুরবানী দিয়ে যাও’। অতঃপর সে একটা মাছি মূর্তির জন্য কুরবানী দিল। তারা লোকটির পথ ছেড়ে দিল। এর ফলে সে জাহান্নামে গেল। অপর ব্যক্তিকে তারা বললো, মূর্তিকে তুমিও কিছু কুরবানী করো। সে বললঃ একমাত্র আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও নৈকট্য লাভের জন্য আমি কারো জন্য কুরবানী দেইনা। এর ফলে তারা তার গর্দান উড়িয়ে দিল। এতে সে জান্নাতে প্রবেশ করল’’।

[হাদীছটি মারফূ‘ হিসাবে যঈফ, তবে মওকূফ হিসাবে ছহীহ। শায়খ আলবানী (রহঃ) বলেন, সালমান ফারেসী (রাঃ) হ’তে মওকূফ সূত্রে এর সনদ ছহীহ (ইমাম আহমাদ, আয-যুহুদ ১/১৫; বায়হাক্বী, শু‘আবুল ঈমান হা/৭৩৪৩, ইবনু আবী শায়বাহ হা/৩৩০৩৮)। তবে তিনি বলেন যে, আমার মনে হয়েছে এটি ইসরাঈলী বর্ণনা। আলবানী বলেন, সালমান ফারেসী যখন খ্রিষ্টান ছিলেন, তখন তিনি তাদের কোন সরদার থেকে এটি শুনে থাকতে পারেন (আলোচনা দ্রঃ সিলসিলা যঈফাহ হা/৫৮২৯)]

আলোচ্য হাদীসের ব্যাখ্যাঃ হাদীছের বর্ণনাকারী হলেন আবু আব্দুল্লাহ্ তারিক বিন শিহাব আল-বাজালী আল-আহমাসী। ইমাম আবু দাউদ (রঃ) বলেনঃ তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দেখেছেন, তবে তাঁর কাছ থেকে কোন হাদীছ শুনেন নি।

হাফেয ইবনে হাজার আসকালানী (রঃ) বলেনঃ তিনি যদি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর সাথে সাক্ষাৎ করে থাকেন অর্থাৎ যদি সাক্ষাৎ করা প্রমাণিত হয়, তাহলে তিনি সাহাবী। এটিও যদি প্রমাণিত হয় যে, সাক্ষাৎ করার পরও তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর কাছ থেকে কোন কিছুই বর্ণনা করেন নি। সুতরাং তিনি যদি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে হাদীছ বর্ণনা করেন, তাহলে তা সাহাবীর মুরসাল হিসাবে গণ্য হবে। প্রাধান্যপ্রাপ্ত মত অনুযায়ী সাহাবীর মুরসাল গ্রহণযোগ্য। ইবনে হিববানের বর্ণনা মতে তিনি ৮৩ হিজরী সালে ইন্তেকাল করেন।

ইমাম ইবনুল কায়্যিম (রঃ) বলেনঃ ইমাম আহমাদ বিন হাম্বাল (রঃ) স্বীয় সনদে তারিক বিন শিহাব থেকে মারফু হিসাবে হাদীছটি বর্ণনা করেছেন যে, এক লোক শুধু মাছির কারণে জান্নাতে প্রবেশ করেছে।

সাহাবীগণ বললেনঃ হে আল্লাহর রাসূল! এটি কিভাবে সম্ভব হল? সম্ভবতঃ তারা এ আমল তথা মূর্তিকে মাছি না দেয়ার কারণে জান্নাতে যাওয়া এবং মূর্তির জন্য মাছি কুরবানী করার কারণে জাহান্নামী হওয়াতে খুব আশ্চর্যবোধ করেছিল। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন সুস্পষ্ট করে বর্ণনা করলেন, যে ব্যক্তি এ কাজ করবে অথবা এর চেয়ে বড় কোন শির্কী কাজ করবে, তার জন্য জাহান্নামের আগুন অবধারিত হবে।

মূর্তির জন্য মাছি পেশকারী জাহান্নামে প্রবেশ করার কারণ হচ্ছে, সে অন্তর দিয়ে গাইরুল্লাহ্-এর সন্তুষ্টি অর্জনের নিয়ত করেছিল এবং কাজের মাধ্যমে তা বাস্তবায়ন করেছিল।

মাছির ঘটনায় মুসলিম শরীফের সেই হাদীছের ব্যাখ্যা রয়েছে, যা জাবের রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে মারফু সূত্রে বর্ণিত হয়েছে। আর সেই হাদীছটি ইতিপূর্বে ‘‘শির্ক হতে ভয়-ভীতি সম্পর্কে’’ নামক শিরোনামে অতিক্রান্ত হয়েছে’’। হাদীছটি হচ্ছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ

«مَنْ لَقِىَ اللَّهَ لاَ يُشْرِكُ بِهِ شَيْئًا دَخَلَ الْجَنَّةَ وَمَنْ لَقِيَهُ يُشْرِكُ بِهِ دَخَلَ النَّارِ»

‘‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক না করে মৃত্যু বরণ করবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। আর যে ব্যক্তি তাঁর সাথে কাউকে শরীক করে মৃত্যু বরণ করবে সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে’’। (বুখারী হা/১২৯; মুসলিম হা/১৫২)

যে ব্যক্তি মূর্তির জন্য একটি মাছি কুরবানী করেছিল, তার পরিণতি যদি এমন হয়ে থাকে, তাহলে যে ব্যক্তি উট, গরু এবং ছাগল মোটা তাজা বানায় এবং সেগুলোকে আল্লাহ্ ব্যতীত অন্যান্য বস্ত্ত যেমন মৃত অথবা অনুপস্থিত অলী-আওলীয়া, কিংবা তাগুত, মাজার, গাছ, পাথর ইত্যাদির জন্য যবেহ করে অথবা অনুরূপ অন্যান্য বস্ত্তর এবাদত করে এবং তার পরিণতি কেমন হবে? অবশ্যই আরো অধিক ভয়াবহ হবে।

মাছির কারণে যে ব্যক্তি জাহান্নামে গিয়েছে সে ছিল একজন মুসলিম। সে যদি কাফের হত তাহলে এ কথা বলা হতনা যে, دخل النار فى ذباب ‘‘একটি মাছির কারণে সে জাহান্নামে প্রবেশ করেছে’’। মূর্তির উদ্দেশ্যে মাছি পেশ করার পূর্বে সে জান্নাতে যাওয়ার যোগ্য ছিল।

উম্মতে মুহাম্মাদীর আখেরী যামানায় মুসলিম পরিচয় ধারণকারী অনেক মুশরিক রয়েছে, যারা তাদের বাতিল মাবুদদের জন্য পশু যবেহ করাকে ঈদুল আযহার দিন কুরবানীর চেয়ে অধিক উত্তম মনে করে। তাদের কেউ কেউ ঈদুল আযহায় কুরবানী যবেহ করার পরিবর্তে অলী-আওলীয়ার মাজার ও দরগায় পশু যবেহ করাকে যথেষ্ঠ মনে করে। তারা আল্লাহ্ ব্যতীত অন্যান্য যেসব বস্ত্তর এবাদত করে ঐ সকল বস্ত্তর প্রতি তাদের প্রবল আগ্রহ থাকা, সেগুলোকে অত্যাধিক সম্মান করা এবং তাদের কাছ থেকে কল্যাণ কামনার কারণেই এরূপ করে থাকে। শুধু তাই নয়, এর চেয়ে অধিক ভয়াবহ শির্কও বর্তমানে ছড়িয়ে পড়েছে।

অপর ব্যক্তিকে তারা বললো, মূর্তির জন্য তুমিও কিছু কুরবানী দিয়ে যাও। সে বললঃ এক আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো নৈকট্য লাভের জন্য আমি কিছুই কুরবানী দেইনা। এর ফলে তারা তার গর্দান উড়িয়ে দিল। এতে সে জান্নাতে প্রবেশ করলো’’। হাদীছের এ অংশ থেকে জানা যাচ্ছে যে, ঈমানদারদের অন্তরে শির্কের ভয়াবহতা অত্যন্ত বড় বলে অনুভূত হয় এবং তারা শির্ককে অন্তর দিয়ে ঘৃণা করে। ইখলাসের উপর তারা হয়ে থাকেন অত্যন্ত মজবুত। আনাস রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদীছ এবং অন্যান্য হাদীছে বর্ণিত হয়েছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ

«ثَلاثٌ مَنْ كُنَّ فِيهِ وَجَدَ حَلاوَةَ الإِيمَانِ: أَنْ يَكُونَ اللَّهُ وَرَسُولُهُ أَحَبَّ إِلَيْهِ مِمَّا سِوَاهُمَا، وَأَنْ يُحِبَّ الْمَرْءَ لا يُحِبُّهُ إِلا لِلَّهِ، وَأَنْ يَكْرَهَ أَنْ يَعُودَ فِي الْكُفْرِ كَمَا يَكْرَهُ أَنْ يُقْذَفَ فِي النَّارِ»

তিনটি গুণ যার মধ্যে বিদ্যমান থাকবে সে ঈমানের প্রকৃত স্বাদ অনুভব করতে পারবে। (১) যার মধ্যে আল্লাহ এবং রাসূলের ভালবাসা অন্যান্য সকল বস্ত্ত হতে অধিক পরিমাণে বিদ্যমান থাকে। (২) যে ব্যক্তি কোন মানুষকে শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য ভালবাসে। (৩) যে ব্যক্তি ঈমান গ্রহণের পর কুফরীতে ফিরে যাওয়াকে তেমনই অপছন্দ করে, যেমন অপছন্দ করে অগ্নিতে নিক্ষিপ্ত হওয়াকে। (বুখারী হা/১৬, ২১)

তাহক্বীক্ব : হাদীছটি সম্পর্কে শায়খ আলবানী বলেন, প্রথমজন দান করেছে জীবনের ভয়ে। অতএব সে জাহান্নামী হবে না। কেননা আল্লাহ বলেন, ঐ ব্যক্তির উপর শাস্তি নেই যে ব্যক্তিকে কুফরীর জন্য বাধ্য করা হয়েছে। অথচ তার হৃদয় ঈমানের প্রতি অবিচল…’ (নাহল ১৬/১০৬)। এখানে কুফরীর আয়াত আনা হয়েছে, অথচ এটা শিরকের হাদীস।

কুরআন ও হাদীসের আলোকে অবিশ্বাসের প্রকাশ তিন প্রকার: (১) কুফর, (২) শিরক ও (৩) নিফাক। ‘কুফর’ শব্দের অর্থ আবৃত করা, অবিশ্বাস করা বা অস্বীকার করা। আমরা ইতোপূর্বে ঈমানের যে বিষয়গুলি জেনেছি সেগুলির কোনো একটি অবিশ্বাস, সন্দেহ বা দ্বিধা করাই কুফর। রব্ব হিসেবে আল্ল­াহর একত্ব, মা’বুদ হিসেবে আল্লাহর একত্ব, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সত্যবাদিতা, নিষ্কলুষ চরিত্র, নিষ্পাপ ব্যক্তিত্ব, তাঁর নুবুওয়াতের বিশ্বজনীনতা, নুবুওয়াতের সমাপ্তি, তাঁর আনুগত্য অনুকরণের বাধ্যবাধকতা, তাঁর শিক্ষার বিশুদ্ধতা, পূর্ণতা, অন্যান্য নবী রাসূলের নবুবওয়াত বা নিষ্পাপত্ব, আখিরাত বিষয়ক প্রমাণিত কোনো বিষয়, তাকদীরের বিষয়ে প্রমাণিত কোনো বিষয় বা ঈমানের যে কোনো প্রমাণিত বিষয় অস্বীকার, অবিশ্বাস, দ্বিধা বা সন্দেহ করলে তা কুফরী বলে গণ্য হবে।

অনুরূপভাবে মহান আল্ল­াহ ছাড়া অন্য কাউকে কোনো বিষয়ে তাঁর সমতুল্য বা সমকক্ষ বা তাঁর সাথে তুলনীয় বলে বিশ্বাস করার মাধ্যমে আল্লাহর একত্ব ও অতুলনীয়ত্ব অস্বীকার করাও কুফর। তবে এ পর্যায়ের কুফরকে ইসলামী পরিভাষায় র্শিক বলা হয়।

কুরআন বা সুন্নাত দ্বারা ব্যাখ্যাতীতভাবে প্রমাণিত কোনো বিধান অবিশ্বাস বা অস্বীকার করা কুফ্রী। সালাত, যাকাত, সিয়াম ইত্যাদির ফরয হওয়া অস্বীকার করা, ব্যভিচার, চুরি, হত্যা ইত্যাদির হারাম হওয়া অস্বীকার করা, সালাতের তাহারাত, রাক‘আত, সময়, সাজদা, রুকুু ইত্যাদির পদ্ধতি অস্বীকার বা ব্যতিক্রম করা এ পর্যায়ের কুফ্র। তবে অজ্ঞতার কারণে অস্বীকার করলে তা ওযর বলে গণ্য হতে পারে। কোনো ইজতিহাদী বা ইখতিলাফী বিষয় অস্বীকার করলে তা কুফ্র বলে গণ্য হবে না।

ছালাত ত্যাগ করলে কুফরী করল, আবার সালাত আদায়ের মাধ্যমে সে দ্বীনে ফিরে আসল। কিন্তু মূর্তি বা বেদীর সামনে পূজা অর্চনা করে তওবা ব্যতীত তা ক্ষমা হবে না। সুতরাং এ আয়াতের ব্যাপারে ব্যাখ্যা হ’ল- আম্মার রাদিয়াল্লাহু আনহুর চোখের সামনে তাঁর পিতা ও মাতাকে কঠিন শাস্তি দিয়ে দিয়ে শহীদ করা হয়।

তারপর তাকে এমন কঠিন অসহনীয় শাস্তি দেয়া হয় যে, শেষ পর্যন্ত নিজের প্রাণ বাঁচাবার জন্য তিনি কাফেরদের চাহিদা মত সবকিছু বলেন। এরপর তিনি কাঁদতে কাঁদতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের খেদমতে হাযির হন এবং আরয করেনঃ “হে আল্লাহর রসূল! আমি আপনাকে মন্দ এবং তাদের উপাস্যদেরকে ভাল না বলা পর্যন্ত তারা আমাকে ছেড়ে দেয়নি” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জিজ্ঞেস করলেন “তোমার মনের অবস্থা কি?” জবাব দিলেন “ঈমানের ওপর পরিপূর্ণ নিশ্চিত।” একথায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেনঃ “যদি তারা আবারো এ ধরনের জুলুম করে তাহলে তুমি তাদেরকে আবারো এসব কথা বলে দিয়ো।” [মুস্তাদরাকে হাকেমঃ ২/৩৫৭, বাইহাকীর আস-সুনানুল কুবরা ২/২০৮-২০৯]।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

loader-image

Scroll to Top