দরসে হাদীস : গরুর দুধ, দধি ও গোশতের উপকার

রাসূলুল্লাহ (ছা.) বলেন, ألبانها شفاء وسمنها دواء ولحومها داء . يعني البقر  ‘গরুর দুধে সুস্থ্যতা ও দধি (ঘী, মাখন, দই) হ’ল রোগ প্রতিষেধক । আর এর গোশত (অধিক) আহারে ব্যাধী রয়েছে (ছহীহুল জামি‘ হা/৪০৬১, হাসান হাদীস)

ব্যাখ্যা :  আপনার গরুর দুধ খাওয়া উচিত, কারণ অনেক গাছ-গাছালি, ঘাস-পাতা থেকে নিংড়ানো নির্যাস থেকে তৈরী হয় দুধ।  অর্থাৎ দুধ বিভিন্ন গাছ এবং বিভিন্ন ধরণের উদ্ভিদের শক্তি দ্বারা গঠিত। এটি একটি রান্না করা মিশ্র (ঘাস-পাতের নির্যাস)পানীয় বা দুধ। যা মানব শরীরকে রোগ থেকে আরোগ্য বা প্রতিরোধ করে। এই দুধ  সর্বশক্তিমান আল্লাহ তা‘আলার শ্রেষ্ঠ্য নেয়ামতের মধ্যে অন্যতম একটি।

প্রশ্ন হতে পারে : গরুর দুধ একটি ওষুধ  এবং এর গোশত একটি রোগ, সুতরাং গরু কুরবানী হতে পারে এই বিষয়টির সাথে আমরা কীভাবে মিলিত হতে পারি, কারণ শারঈ আইন অনুসারে, একজন ব্যক্তির পক্ষে ক্ষতিকারক কিছু দ্বারা পরিচালিত হওয়া সম্ভব নয়। তাই নয় কি ?

উত্তর : হ্যাঁ; নবী (ছা.)) থেকে এটি প্রমাণিত হয়েছে যে, বিদায় হজ্জের সময় তিনি তাঁর স্ত্রীদের জন্য গরু কুরবানী করেছিলেন। আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, ‘আমরা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সাথে এক সফরে ছিলাম। এমতাবস্থায় কুরবানীর ঈদ উপস্থিত হ’ল। তখন আমরা সাত জন একটি গরুতে ও দশ জন একটি উটে শরীক হ’লাম (ছহীহ তিরমিযী হা/১২১৪; ছহীহ ইবনে মাজাহ হা/৩১২৮, ছহীহ নাসাঈ হা/৪০৯০; সনদ ছহীহ, আলবানী, মিশকাত হা/১৪৬৯, ‘কুরবানী’ অনুচ্ছেদ)।  এটিও বৈধ।  তবে গরু মোটাতাজা করা হলে তার গোশত নিষেধ হবে।

এর দধি একটি রোগ নিরাময় এবং এর গোশত একটি ব্যাধী। আলেমগণ এই হাদিসটিকে তাঁর সম্পর্কে হাদীসের সাথে সমন্বয় করেছেন – তাঁর স্ত্রীদের পক্ষ থেকে গরু কুরবানী করা। তিনি যখন নিষেধ করেন তখন কী বোঝায়? গরুর গোশত অনেক খেতে হয়। কিন্তু যদি মাঝে মাঝে তা থেকে খায় তাহলে তাতে কোন ক্ষতি বা ক্ষতির আশংকা নেই।  এটা নিঃসন্দেহে জায়েয কারণ গরুর গোশত পরিমিত ভক্ষণ করলে তা দোষণীয় নয়। সুতরাং বেশী বেশী ভক্ষণ থেকে বিরত হবো এবং ভেড়া, ছাগল ও উটের গোশত বেশী বেশী ভক্ষণ করে তথায় প্রতিস্থাপন করা উচিৎ। তাছাড়া ঈদের আনন্দে গরু কুরবানীতে গোশত খেলে মানুষ সুস্থ্যতাবোধ করেন । এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে বান্দার জন্য নেয়ামত স্বরূপ।

আর সকল ক্ষেত্রে অসাধুতা তথা গরু মোটা তাজা করণের নামে ফিড বা ভ্যাকসিন দিয়ে অস্বাস্থ্যকর করে গোশত পরিবেশ করা শরীয়ত বিরোধী। যা মুনাফাধোর হিসেবে হারাম পর্যায়ে চলে যাবে। এ থেকে বিরত থাকা প্রত্যেক মুমিনের ঈমানী দায়িত্ব ও কর্তব্য। আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে সঠিক বুঝ দান করুন, আমীন।

(ক) গরুর দুধের উপকারিতা :

শিশু, প্রাপ্তবয়স্ক ও বৃদ্ধ–সবারই প্রতিদিন এক গ্লাস দুধ পান করা উচিত। দুধ ভিটামিন ডি ও ক্যালসিয়ামের উৎস। দুধে আছে প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেট, চর্বি, ওমেগা থ্রি, ওমেগা সিক্সসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। দুধকে বলা হয় সুপার ফুড। এতে আছে প্রয়োজনীয় ভিটামিন ও খনিজ পদার্থ, যা শরীরের জন্য জরুরি। এতে প্রচুর ভিটামিন বি-১২ আছে, যা মস্তিষ্কের জন্য প্রয়োজন। দুধ শরীরকে কর্মক্ষম রাখতে সাহায্য করে। এ ছাড়া দেহের টিস্যু ও কোষ মেরামতের জন্য দারুণ উপকারী।

১. কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে রাখে। ২. ঘুম ভালো হয়। ৩. হাড় মজবুত করে। ৪. সারাদিনের শক্তি অর্জিত হয়। ৫. ত্বক সুন্দর করে।

(খ) ছাগলের দুধের উপকারিতা :

১. হার্ট ভালো রাখে। ২. পুষ্টিগুণ মায়ের বুকের দুধের কাছাকাছি। ৩. এলার্জি প্রবণতা কম। ৪. উচ্চ ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ। ৫. ত্বকের যত্নে উপকারী। ৬. ল্যাকটোজ অসহিষ্ণু।

৭. হজম করা যায় সহজেই। ৮. এলার্জি নিয়ন্ত্রণ করে। ৯. হাঁড়ের গঠনকে শক্তিশালী করে। ১০. কোলেস্টেরল কম। ১১. বাড়ন্ত শিশুর জন্য উপকারী।

(গ) দুধ হতে তৈরী টক দইয়ের উপকারিতা :

১. এতে আছে প্রচুর পরিমান ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি, যা হাড় ও দাঁতের গঠনে সহায়ক। মহিলাদের টক দই বেশী প্রয়োজন, কেননা তারাই ক্যালসিয়ামের অভাবে বেশী ভোগেন।

২. টক দইয়ের ব্যাকটেরিয়া অত্যন্ত উপকারী। এটা শরীরের ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়াকে মেরে ফেলে এবং উপকারী ব্যাকটেরিয়া বাড়িয়ে হজম শক্তি বৃদ্ধি করে।

৩. টক দই শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। এছাড়া ঠান্ডা, সর্দি, জ্বরকে দূরে রাখে।

৪. টক দইয়ে আছে ল্যাকটিক অ্যাসিড, যা কোষ্টকাঠিন্য দূর করে ও ডায়রিয়া প্রতিরোধ করে। এটি কোলন ক্যান্সার রোগীদের খাদ্য হিসাবে উপকারী।

৫. যারা দুধ খেতে পারেন না বা দুধ যাদের হজম হয় না, তারা অনায়াসেই টক দই খেতে পারেন। কারণ টক দইয়ের আমিষ দুধের চেয়ে সহজপাচ্য। ফলে স্বল্প সময়ে হজম হয়।

৬. টক দই ওজন কমাতেও সাহায্য করে। এর আমিষের জন্য পেট ভরা বোধ হয় ও শরীরে শক্তি পাওয়া যায়। ফলে অতিরিক্ত খাবার গ্রহণ করতে ইচ্ছে করে না। আর অতিরিক্ত খাবার খাওয়া বন্ধ হ’লে সহজেই ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।

৭. টক দই শরীরের উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখে। প্রতিদিন মাত্র এক কাপ করে টক দই খেলে উচ্চ রক্তচাপ প্রায় এক তৃতীয়াংশ কমে যায় এবং স্বাভাবিক হয়ে আসে। এছাড়া এটি রক্তের খারাপ কোলেষ্টেরলের মাত্রাও কমিয়ে দেয়।

৮. হার্টের অসুখ ও ডায়াবেটিসের রোগীরা টক দই খেলে রোগ নিয়ন্ত্রণে থাকে।

৯. টক দই শরীরে টক্সিন জমতে দেয় না। ফলে অন্ত্রনালী পরিস্কার থাকে। যা শরীরকে সুস্থ রাখে ও বার্ধক্য রোধে সাহায্য করে।

১০. নিয়মিত টক দই খেলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে।

(গ) গরুর গোশতের উপকারিতা ও অপকারিতা :

গরুর গোশতে আছে শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় নয়টি পুষ্টি উপাদান। সেগুলো হলো প্রোটিন, জিঙ্ক, ভিটামিন বি-১২, সেলেনিয়াম, আয়রন, রিবোফ্লেভিন, ফসফরাস, নায়াসিন এবং ভিটামিন বি-৬। উপকারিতার পাশাপাশি গরুর গোশতের আছে কিছু ক্ষতিকর দিকও। জেনে নিন গরুর গোশত খাওয়ার উপকারিতা ও অপকারিতা-

১. গরুর গোশতের উপকারিতা :

ক. শিশুর বৃদ্ধিতে সহায়ক : গরুর গোশত খেলে তা আমাদের বুদ্ধি-বৃত্তিক গঠন, শারীরিক বর্ধন ও রক্ত বর্ধনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ৮৫ গ্রাম গরুর গোশতে ৯-১৩ বছর বয়সী শিশুর দৈনিক চাহিদার ১২৫ শতাংশ ভিটামিন বি-১২, ৯০ শতাংশ প্রোটিন, ৩২ শতাংশ আয়রন, ২৯ শতাংশ নায়াসিন, ৭৪ শতাংশ জিঙ্ক, ৪২ শতাংশ সেলেনিয়াম, ৩২ শতাংশ ভিটামিন বি-৬, ২৩ শতাংশ রিবোফ্লেভিন এবং ১৬ শতাংশ ফসফরাস থাকে।

খ. খনিজের অভাব দূর করে: শরীরে খনিজের অভাবে সৃষ্ট অসুখ-বিসুখ দূর করতে কাজ করে গরুর গোশত। কারণ এটি খনিজ লবণের দুর্দান্ত উৎস। গরুর গোশতে থাকে জিংক, ফসফরাস, সেলেনিয়াম এবং প্রচুর লৌহ। এই গোশত ভিটামিনের গুরুত্বপূর্ণ উৎস। গরুর গোশত ভিটামিন বি-৩, বি-৬, বি-১২ ইত্যাদি ভিটামিনের জোগান দেয়।

গ. প্রোটিনের ভালো উৎস: গরুর গোশত প্রোটিনের ভালো উৎস। গোশত ছাড়াও হাড়, কলিজা, মগজ ইত্যাদি থেকে মেলে প্রোটিন। এই প্রোটিন থেকে পাওয়া অ্যামাইনো এসিড কাজে লাগে হাড় ও গোশত পেশি ভালো রাখতে। প্রতি ১০০ গ্রাম গরুর গোশতে পাওয়া যায় ২২.৬ গ্রাম প্রোটিন।

ঘ. জিংকের ঘাটতি দূর করে: আমাদের সুস্থতার জন্য জিংক একটি জরুরি উপাদান। এটি আমাদের শরীরের কোষ ভালো রাখে এবং বাড়ায় রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা। ৮৫ গ্রাম গরুর গোশত খেলে তা দৈনিক জিংকের ৩৯ শতাংশ পূরণ করে।

২. গরুর গোশতের অপকারিতা :

ক. কোষ্ঠকাঠিন্যের ঝুঁকি বাড়ায় : অনেকে অতিরিক্ত গরুর গোশত খেয়ে ফেলেন। এতে বাড়ে কোষ্ঠকাঠিন্যের ঝুঁকি। কোষ্ঠকাঠিন্য থেকে পরবর্তীতে আরও বড় অসুখ দেখা দিতে পারে। তাই অতিরিক্ত গরুর গোশত খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। গরুর গোশতের সঙ্গে নানা ধরনের সবজি মিলিয়ে খেলে কোষ্ঠকাঠিন্য থেকে অনেকটাই মুক্তি পাওয়া যাবে।

খ. কোলন ক্যান্সারের ঝুঁকি : অতিরিক্ত গরুর গোশত খাওয়া মোটেও উপকারী নয়। তাই খেতে যতই ভালো লাগুক, গরুর গোশত খেতে হবে পরিমিত। চিকিৎসকদের মতে, সপ্তাহে পাঁচ বেলা গরু, খাসি কিংবা ভেড়ার গোশত খেলে বাড়ে কোলন ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি। সেইসঙ্গে প্রক্রিয়াজাত লাল গোশত খেলে তা মৃত্যু ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে দেয়। 

গ. হৃদরোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি : আপনি হয়তো জেনে থাকবেন, গরুর গোশত খেলে উচ্চ রক্তচাপ হতে পারে। কারণ এতে থাকা অতিরিক্ত সোডিয়াম শরীরের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। কারণ রক্তচাপ সৃষ্টিতে বা বাড়াতে কাজ করে সোডিয়াম। তাই গরুর গোশত খেলে হতে পারে উচ্চ রক্তচাপ। সেখান থেকে দেখা দেয় হৃদরোগ ও স্ট্রোকের মতো সমস্যা।

৩. যতটুকু গরুর গোশত খেতে পারবেন :

 দৈনিক গরুর গোশত খেতে পারবেন ৮৫ গ্রাম। ৮৫ গ্রাম চর্বি ছাড়া গরুর গোশত খেলে তা আপনার দৈনিক ক্যালোরির চাহিদার ১০ শতাংশ পূরণ করবে। রান্না করা ৩ টুকরা মাংসে ৮৫ গ্রাম হয়, তাই চেষ্টা করুন দিনে ৩ টুকরার বেশি গোশত না খেতে। যদি একবারে আরও বেশি গোশত খেয়ে ফেলার ভয় থাকে তবে সপ্তাহে দুইদিনের বেশি গরুর গোশত না খাওয়াই ভালো।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

loader-image

Scroll to Top