লজ্জা ঈমানের এক অপরিহার্য গুণ। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য এবং কল্যাণপ্রাপ্ত মানুষের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গুণ হল লজ্জাশীলতা। এটা মানুষকে অন্যায় ও অপরাধমুক্ত থাকতে সহায়তা করে। যার লজ্জা-শরম কম, তার আল্লাহভীতি কম। আর যার আল্লাহভীতি কম তার অন্তর নিস্প্রাণ ফসলহীন বিরাণ মাঠের মত। সে কোন ভাল কাজ করার আগ্রহ পায় না ফলে সে কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হয়। অপরদিকে লজ্জাশীল ব্যক্তির কাছে কল্যাণ আগমন করে উপর থেকে পানির স্রোতধারা দ্রুত নিচে নেমে আসার মতো। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, الْحَيَاءُ لاَ يَأْتِي إِلاَّ بِخَيْرٍ ’লজ্জশীলতা কল্যাণ বৈ কিছু নিয়ে আসে না’ (বুখারী হা/৬১১৭)।
অন্যত্র তিনি বলেন, ’প্রত্যেক ধর্মেরই একটা স্বভাব রয়েছে, আর ইসলামের স্বভাব হ’ল লজ্জা’’ (মিশকাত হা/৫০৯০)। ’’নির্লজ্জ ব্যক্তিই ধর্ম ত্যাগী মুর্খ’’।
লজ্জা, শরম না থাকলে মানুষ ব্যক্তিগত, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক জীবনে পাপ-পঙ্কিলতা, দুর্নীতি-দুঃশাসন, অন্যায়-অবিচার থেকে পরিপূর্ণরূপে মুক্ত থাকতে পারেনা। লজ্জা বনি আদমকে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের অসমর্থিত পথ-পন্থা থেকে পরিপূর্ণরূপে বিরত রাখে এবং এই লজ্জার পূর্ণতার মাধ্যমে ঈমানের পূর্ণতা হাসিল হয়। লজ্জা মানুষকে প্রকৃত মানুষরূপে গড়ে তোলে। যার লজ্জা নেই, সে যা ইচ্ছা করতে পারে।
পরিচয় :
হায়া (حیاء) শব্দটি হাইয়ুন (حیی) মাসদার থেকে নির্গত। অর্থ: লজ্জা, শরম ইত্যাদি। শাব্দিক অর্থে লজ্জা বলা হয়, যে কাজ করলে মানুষ নিন্দনীয়, অপমানিত হওয়ার আশঙ্কা করে সেই কাজ থেকে বিরত থাকা।
শরীয়তের পরিভাষায়, হায়া তথা লজ্জা এমন এক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য যা মানুষকে সকল খারাপ কথা ও কাজ থেকে ফিরিয়ে রাখে এবং হকদারকে তার হক পৌঁছে না দেয়ার অপরাধ থেকে বিরত রাখে। (আল মাউসূয়াতুল ফিকহিয়্যা, খন্ড ১৮, পৃষ্ঠা ২৫৯)।
লজ্জা তিন প্রকার :
নিজেকে লজ্জা, মানুষকে লজ্জা ও আল্লাহকে লজ্জা। প্রথম প্রকারের লজ্জা থেকে মানুষ বেপরওয়া। সে গোপনে ও একাকী যা ইচ্ছা তাই করে। অথচ সে জানেনা যে, অনেকগুলি অবিচ্ছেদ্য সাক্ষী সর্বদা তার সাথে রয়েছে। যাদেরকে বাদ দিয়ে সে কিছুই করতে পারে না। ঐ সাক্ষীগুলি হ’ল তার দেহচর্ম ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গাদি। আল্লাহ বলেন, الْيَوْمَ نَخْتِمُ عَلَى أَفْوَاهِهِمْ وَتُكَلِّمُنَا أَيْدِيهِمْ وَتَشْهَدُ أَرْجُلُهُمْ بِمَا كَانُوا يَكْسِبُونَ ‘আজ আমরা তাদের মুখে মোহর এঁটে দিব। আর তাদের হাত আমাদের সাথে কথা বলবে এবং তাদের পা তাদের কৃতকর্মের সাক্ষ্য দিবে’ (ইয়াসীন ৩৬/৬৫)।
লজ্জাশীলতা এমন একটি বিষয় যা মুমিনের দেহে ঈমানের উপস্থিতির লক্ষণ প্রকাশ করে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, الإِيمَانُ بِضْعٌ وَسِتُّونَ شُعْبَةً، وَالْحَيَاءُ شُعْبَةٌ مِنَ الإِيمَانِ ঈমানের ষাটেরও অধিক শাখা আছে। আর লজ্জা হচ্ছে ঈমানের একটি শাখা। তিনি আরো বলেন, إِنَّ لِكُلِّ دِينٍ خُلُقًا وَخُلُقُ الإِسْلاَمِ الْحَيَاءُ প্রতিটি ধর্মেরই একটা স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য আছে। আর ইসলামের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য হলো লজ্জাশীলতা। [সুনানে ইবনু মাজাহ হা/৪১৮১]
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, তোমরা আল্লাহকে লজ্জা কর সত্যিকারের লজ্জা। আমরা বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমরা অবশ্যই আল্লাহকে লজ্জা করি- আলহামদুলিল্লাহ। তিনি বললেন, «لَيْسَ ذَلِكَ وَلَكِنَّ مَنِ اسْتَحْيَى مِنَ اللَّهِ حَقَّ الْحَيَاءِ فَلْيَحْفَظِ الرَّأْسَ وَمَا وَعَى وَلْيَحْفَظِ الْبَطْنَ وَمَا حَوَى وَلْيَذْكُرِ الْمَوْتُ وَالْبِلَى وَمَنْ أَرَادَ الْآخِرَةَ تَرَكَ زِينَةَ الدُّنْيَا فَمَنْ فَعَلَ ذَلِكَ فَقَدِ اسْتَحْيَى مِنَ اللَّهِ حَقَّ الْحَيَاءِ» .
কথা সেটা নয়। বরং আল্লাহকে যথার্থভাবে লজ্জা করার অর্থ এই যে,
(১) তুমি তোমার মাথা ও যেগুলিকে সে জমা করে, তার হেফাযত কর।
(২) তুমি তোমার পেট ও যেগুলিকে সে জমা করে, তার হেফাযত কর।
(৩) আর তোমার বারবার স্মরণ করা উচিৎ মৃত্যুকে ও তার পরে পচে-গলে যাওয়াকে।
(৪) আর যে ব্যক্তি আখেরাত কামনা করে, সে যেন পার্থিব বিলাসিতা পরিহার করে। যে ব্যক্তি উপরোক্ত কাজগুলি করে, সে ব্যক্তি সত্যিকার অর্থে আল্লাহকে লজ্জা করে’। [আহমাদ হা/৩৬৭১; তিরমিযী হা/২৪৫৮, মিশকাত হা/১৬০৮, সনদ হাসান ‘জানায়েয’ অধ্যায় ‘মৃত্যু কামনা’ অনুচ্ছেদ।]
‘তোমরা আল্লাহকে লজ্জা কর’ অর্থ আল্লাহকে যথাযথভাবে ভয় কর ও শ্রদ্ধা কর। অর্থাৎ তার শাস্তির ভয়ে নয় কিংবা কিছু পাওয়ার আশায় নয়। বরং তার বড়ত্ব ও সর্বোচ্চ মর্যাদাকে সম্মান কর। তিনি তোমার সব কথা শুনছেন। অতএব এমন কথা বলো না, যাতে তিনি কষ্ট পান ও তিনি অসম্মানিত বোধ করেন। তুমি তোমার গুরুজনের সামনে অনেক কথা বলতে লজ্জা পাও। লোকজনের সামনে অনেক কথা বলতে ভয় পাও। কেউ শুনে ফেলবে সেই ভয়ে অনেক কথা চেপে যাও। তাহ’লে কি তুমি তোমার সৃষ্টিকর্তাকে ভয় করবে না, যিনি তোমার গোপন কথা শোনেন ও মনের কথা জানেন? লোকলজ্জার ভয়ে কিংবা ধরা পড়ার আশংকায় তুমি প্রকাশ্যে কোন মন্দকর্ম করো না। অথচ গোপনে বা অন্ধকারে তুমি সেই কাজ করছ। কারণ মানুষ দেখছে না। অথচ আল্লাহ সবই দেখছেন। অতএব তুমি যেমন মানুষ থেকে লজ্জা পাও, তেমনি আল্লাহকে লজ্জা কর। তাঁর চোখের আড়ালে তুমি কিছুই করতে পারবে না। তুমি সর্বদা তাঁর চোখের সামনে রয়েছ। অতএব মনিবের সামনে চাকর যেভাবে কাজ করে, তুমি সেভাবে ভীত ও সতর্কভাবে কাজকর্ম কর।
লজ্জা সম্পর্কে কবি বলেন,
লজ্জা যদি না থাকে ভাই কেমনে মুসলমান,
সকল কিছু বাদ করে পড়ি আল-কুরআন।
আসুন সবায়! কুরআন-হাদীছ মানি ছোট্ট এই জীবনেতে,
সুখে-শান্তিতে থাকব মোরা পরোকালে জান্নাতে।