উম্মতে মুহাম্মাদ (ছা.)-এর ঐ সকল মানুষকে বুঝানো হয়েছে যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে। দ্বীনের বিধি-বিধানে আদেশ মেনে চলে এবং নিষেধ পরিত্যাগ করে ।
(১) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, نحن آخر الأمم و أول من يحاسب يقال : أين الأمة الأمية و نبيها ؟ فنحن الآخرون الأولون . “আমরা হলাম জাতিসমূহের সর্বশেষ। কিন্তু কেয়ামতে আমাদের হিসাব সর্ব প্রথম করা হবে। তখন বলা হবে: উম্মী (আসল) জাতি ও তাদের নবী কোথায়? তাই আমরা সর্বশেষ অথচ মর্যাদায় প্রথম”। (ইবনু মাজাহ হা/৪২৯০, ছহীহুল জামি‘ হা/৬৭৪৯) আমরা সৌভাগ্যবান উম্মত, লা তাহযান। বুরাইদাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, « أَهْلُ الْجَنَّةِ عِشْرُونَ وَمِائَةُ صَفٍّ ثَمَانُونَ مِنْهَا مِنْ هَذِهِ الأُمَّةِ وَأَرْبَعُونَ مِنْ سَائِرِ الأُمَمِ ». ‘জান্নাতীদের একশত বিশটি কাতার হবে, তার মধ্যে এই উম্মাতের হবে আশিটি কাতার এবং অন্যান্য সকল উন্মাতের হবে চল্লিশটি’ (তিরমিযী, দারেমী, মিশকাত হা/৫৬৪৪) ।
(২) আবূ উমামাহ্ (রাঃ) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছি, «وَعَدَنِي رَبِّي أَنْ يُدْخِلَ الْجَنَّةَ مِنْ أُمَّتِي سَبْعِينَ أَلْفًا لَا حِسَابَ عَلَيْهِمْ وَلَا عَذَابَ مَعَ كُلِّ أَلْفٍ سَبْعُونَ أَلْفًا وَثَلَاثُ حَثَيَاتٍ مِنْ حَثَيَاتِ رَبِّي» ‘আমার প্রভু আমার সাথে ওয়াদা করেছেন যে, তিনি আমার উম্মতের মধ্য থেকে সত্তর হাজার লোককে বিনা হিসাবে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন এবং তাদের ওপর ’আযাবও হবে না। আবার উক্ত প্রত্যেক হাজারের সাথে সত্তর হাজার এবং আমার প্রভুর তিন অঞ্জলি ভর্তি লোকও জান্নাতে প্রবেশ করাবেন’। (আহমাদ হা/২২৩৫৭, তিরমিযী হা/২৪৬৭, ছহীহুল জামি‘ হা/৭০৬২, মিশকাত হা/৫৫৫৬)। আল্লাহ তা‘আলা রাসূল (ছা.)-কে এ উম্মতের তিন অঞ্জলি ভর্তি লোক জান্নাতে দিয়ে সন্তুষ্ট করেদিবেন ।
(৩) আবূ হুরায়রা (রাঃ) ও হুযায়ফাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাদীসের শেষ দিকে বলেছেন, ‘দুনিয়ায় আগমনের দিক দিয়ে আমরা সকলের পেছনে। কিন্তু কিয়ামতের দিন আমরা সকলের আগে থাকব। সকলের আগে আমাদের হিসাব নেয়ার ও জান্নাতে প্রবেশ করার হুকুম দেয়া হবে। (মুসলিম হা/৮৫৬, মিশকাত হা/১৩৫৫)
(৪) আবূ হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ আমরা দুনিয়ার শেষের দিকে এসেছি। তবে কিয়ামতের (কিয়ামতের) দিন মর্যাদার দিক থেকে আমরা সবার আগে থাকব। তাছাড়া ইয়াহূদী নাসারাদেরকে আমাদের পূর্বে কিতাব দেয়া হয়েছে। আর আমাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছে পরে। অতঃপর এ ’জুমু’আর দিন’ তাদের উপর ফরয করা হয়েছিল। কিন্তু তারা এ নিয়ে মতভেদ করলে আল্লাহ তা’আলা ওই দিনটির ব্যাপারে আমাদেরকে সঠিক পথ প্রদর্শন করলেন। এ লোকেরা আমাদের অনুসরণকারী। ইয়াহূদীরা আগামীকালকে অর্থাৎ ’শনিবারকে’ গ্রহণ করেছে। আর নাসারারা গ্রহণ করেছে পরশুকে অর্থাৎ ’রবিবারকে’। (বুখারী হা/৮৭৬ ও ৩৪৪৬, মুসলিম হা/৮৫৫, মিশকাত হা/১৩৫৪)
ব্যাখ্যা: হাফিয আসক্বালানী (রহঃ) বলেন যে, আমরা যামানাগত দিক সর্বশেষ এবং ক্বিয়ামাতে মর্যাদার দিক দিয়ে আমরাই প্রথম। এখানে মূল উদ্দেশ্য হলোঃ এ উম্মাতগণ দুনিয়াতে তাদের উপস্থিতির ক্ষেত্রে অতীতের সকল উম্মাতের শেষে, কিন্তু আখিরাতে সবার অগ্রবর্তী হবে। কারণ সর্বপ্রথম যারা হাশর, হিসাব, বিচার এবং জান্নাতে প্রবেশ করবে তারাই হলো এ উম্মাত বা নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উম্মাত। আর সে দিনটি হলো জুমু‘আর দিন। (يومهم الَّذِي فرض) ইবনু হাজার বলেন এখানে يوم দ্বারা (يوم الجمعة) বা জুমু‘আর দিন উদ্দেশ্য আর فرض দ্বারা উদ্দেশ্য হলো এ দিনের সম্মান, যেমন সহীহ মুসলিমে আবূ হুরায়রা (রাঃ)-এর অপর বর্ণনায় রয়েছে, ‘‘আল্লাহ তা‘আলা আমাদের পরবর্তীদের জুমু‘আর দিন থেকে পথভ্রষ্ট করেছেন।’’ আল্লামা ক্বাসত্বালানী (রহঃ) বলেনঃ আবূ হাতিম (রহঃ) সানাদী (রহঃ) থেকে বর্ণনা করেন যে, আল্লাহ ইয়াহূদীদের ওপর জুমু‘আহ্ (শুক্রবারে) ফরয করলেন অতঃপর তারা তা অস্বীকার করল এবং তারা বলল, হে মূসা! আল্লাহ তা‘আলা তো শনিবারে কিছুই সৃষ্টি করেননি কাজেই সে দিনটি আমাদের নির্ধারণ করে দাও। অতঃপর তিনি তাদের ওপর তা নির্ধারণ করলেন। কুসত্বালানী (রহঃ) বলেনঃ তাদের ওপর জুমু‘আর দিন নির্ধারণ হওয়ার পর এবং উক্ত দিবসের সম্মান করার নির্দেশপ্রাপ্ত হওয়ার পর তারা তা পরিত্যাগ করল এবং তারা তাদের ক্বিয়াসকেই প্রাধান্য দিলো। অতঃপর তারা শনিবারকে সম্মান করা শুরু করল, এ দিনে (শনিবার) সৃষ্টি থেকে অবসর গ্রহণের কারণে এবং তারা (ইয়াহূদীরা) ধারণা করল যে, এ দিন বড় ফাযীলাতের দিন, এ দিনকে সম্মান করা তাদের ওপর ওয়াজিব এবং তারা বলে যে, এ দিনে আমরা ‘আমলের মাধ্যমে আনন্দ উপভোগ করি ও ‘ইবাদাতে ব্যস্ত থাকি। আর নাসারাগণ রবিবারের দিনকে সম্মান করত, কারণ এ দিনেই আল্লাহ তা‘আলা সৃষ্টির সূচনা করেছেন, কাজেই (তাদের যুক্তি) এ দিন সম্মানের সর্বাধিক হকদার। এ দিনের (জুমু‘আর দিন শুক্রবার) সম্মানের ক্ষেত্রে ওয়াহীর মাধ্যমে আল্লাহ আমাদের পথ দেখিয়েছে যেমন- ‘আবদুর রাযযাক্ব (রহঃ) বিশুদ্ধ সানাদে ইবনু সীরীন (রহঃ) থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন যে, মদীনাহবাসীগণ একত্রিত হলেন নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মদীনায় আগমন ও জুমু‘আর দিন অবতীর্ণ হওয়ার পূর্বে। অতঃপর আনসারগণ বললেন যে, ইয়াহূদীদের একটি দিন রয়েছে প্রতি সপ্তাহে তারা সেদিনে একত্রিত হয় এবং নাসারাদেরও অনুরূপ দিন রয়েছে, তবে আমরা কি একটি দিন নির্ধারণ করতে পারি না? যেদিনে আমরা একত্রিত হব, আল্লাহর যিকর করব, সালাত আদায় করব ও আল্লাহর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করব। অতঃপর তারা ‘আরুবাহ্ দিবস গ্রহণ করল এবং এ দিনে তারা আস্ওয়াদ ইবনু যুরারাহ্ (রাঃ)-এর নিকট একত্রিত হলে তিনি তাদের সাথে উক্ত দিনে সালাত আদায় করলেন। অতঃপর আল্লাহ নাযিল করলেন, ‘‘জুমু‘আর দিনে যখন ডাকা হবে তখন তোমরা আল্লাহর ডাকে দ্রুত সাড়া দাও…..।’’ (জুমু‘আ ৬২/৯)
কিয়ামতের মাঠে মুমিন বান্দা তথা নাজি ফির্কার লোক প্রতি হাযারে একজন হবে এবং জান্নাতের একশত বিশ কাতারে আশি কাতার হবেন মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর জান্নাতি উম্মত। আলী (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আমাকে এমন কয়েকটা জিনিস দেয়া হয়েছে, যা আর কাউকে দেয়া হয়নি। আমরা বললামঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ, কী কী? তিনি বললেনঃ আমাকে ভয় দ্বারা সাহায্য করা হয়েছে (অর্থাৎ ইসলামের শত্রুরা আমাকে ও আমার উম্মাতকে ভয় পায়), আমাকে পৃথিবীর চাবিকাঠি দেয়া হয়েছে (অর্থাৎ পৃথিবীর প্রচুর সম্পদ আমার উম্মাতকে দেয়া হয়েছে)। আমার নাম রাখা হয়েছে আহমাদ, মাটিকে আমার জন্য পবিত্রতা অর্জনের উপকরণ বানানো হয়েছে এবং আমার উম্মাতকে শ্ৰেষ্ঠ জাতি বানানো হয়েছে। (মুসনাদ আহমাদ হা/৭৬৩)
অতএব, নিরাশ হবেন না; বরং ফির্কায়ে নাজিয়ার অন্তর্ভূক্ত হোন। আল্লাহ আমাদের সকলকে হক্বের ওপর টিকে থাকার তাওফীক্ব দান করুন, আমীন।