মানুষদেরকে আল্লাহ প্রদত্ত সাওয়াব যা তিনি সৎকর্মের জন্য দান করেন তা জানিয়ে দিতে হবে সহজ পন্থায়। আনাস (রাযি.) থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, يَسِّرُوا وَلَا تُعَسِّرُوا وَبَشِّرُوا وَلَا تُنَفِّرُوا ‘তোমরা সহজ পন্থা অবলম্বন কর, কঠিন পন্থা অবলম্বন করো না, মানুষকে সুসংবাদ দাও, বিরক্তি সৃষ্টি করো না’ (বুখারী হা/৬৯)।
অপর বর্ণনায় এসেছে, আবূ মূসা আল আশ্’আরী (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখনই কোনো কাজে কোনো সাহাবীকে পাঠাতেন তখন বলতেন, ‘তোমরা জনগণকে আশার বাণী শুনাবে। হতাশাব্যঞ্জক কথা বলে তাদের জন্য অবহেলা-ঘৃণা সৃষ্টি করবে না। তাদের সাথে সহজ-সরল বিধান নীতি ব্যবহার করবে, কঠোরতা অবলম্বন করবে না’ (বুখারী হা/৬১২৪, মুসলিম হা/১৭৩২, মিশকাত হা/৩৭২২)।
শ্রোতা যাতে বিরক্ত না হয়, সেজন্য নসীহত ও ইলম শিক্ষাদানে সময়ের প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে। দ্বীন প্রচারের ক্ষেত্রে সহজ পন্থা অবলম্বন করার প্রতি গুরুত্বারোপ করার কারণ হলো- মানুষ সহজ ও দ্রুত প্রিয় জীব। এদেরকে হিকমাতের সাথে সহজভাবে দাওয়াত দিতে হবে। আল্লাহ তা’আলা বলেন, ٱدۡعُ إِلَىٰ سَبِيلِ رَبِّكَ بِٱلۡحِكۡمَةِ وَٱلۡمَوۡعِظَةِ ٱلۡحَسَنَةِۖ ‘তুমি মানুষকে তোমার প্রতিপালকের পথে আহবান কর হিকমত ও সদুপদেশ দ্বারা’ (নাহল ১২৫)।
এখানে ইসলাম প্রচার ও তাবলীগের মূলনীতি হলো- হিকমত, সদুপদেশ ও নম্রতা। এর উপর ভিত্তিশীল এবং গঠনমূলক আলোচনার সময় সদ্ভাব বজায় রাখা, কঠোরতা পরিহার করা এবং নম্রতার পথ অবলম্বন করা বাঞ্ছনীয়। তাছাড়া উল্লিখিত নীতি অনুসারে উপদেশ মূলক দ্বীন প্রচার ও প্রসার করা। আর হিদায়াতের রাস্তায় পরিচালিত করা আল্লাহর আয়ত্তাধীন। এছাড়া একমাত্র তিনিই জানেন, কে হেদায়েত গ্রহণকারী এবং কে হেদায়েত প্রত্যাখ্যানকারী?
রাসূল (সা.) মানুষকে দ্বীন ও দুনিয়ার সকল কাজে হালকা ও সহজ করতে আদেশ দিয়েছেন এবং কঠিন করতে নিষেধ করেছেন। আর এটি আল্লাহ তা‘আলা যা ছাড় দিয়েছেন ও শরী‘য়ত সম্মত করেছেন তার পরিসীমারেখার মধ্যে থাকবে। তাছাড়া সদা মানুষকে কল্যাণকর কাজের সুসংবাদ দেওয়া, নসীহা করা এবং কোন ভাবে তাদেরকে দূরে ঠেলে না দেওয়ার ব্যাপারে উৎসাহ-উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। অপর এক হাদীসে এসেছে, আবুল ইয়াক্বাযান ’আম্মার ইবনে ইয়াসের রাদিয়াল্লাহু ’আনহু বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, «إنَّ طُولَ صَلاَةِ الرَّجُلِ، وَقِصَرَ خُطْبَتِهِ، مَئِنَّةٌ مِنْ فِقهِهِ، فَأَطِيلُوا الصَّلاَةَ وَأقْصِرُوا الْخُطْبَةَ » ‘মানুষের দীর্ঘ সালাত ও তার সংক্ষিপ্ত খুৎবা তার শারঈ জ্ঞানের পরিচায়ক। অতএব তোমরা সালাত লম্বা করো এবং খুৎবা ছোট করো’ (মুসলিম হা/৮৬৯)।
আল্লামা ত্বীবী (রহঃ) বলেন, বাক্য দু’টি রূপকভাবে পরস্পর বিরোধী কারণ যদি বাস্তবিক বিপরীতমুখী হতো তাহলে ইবারতটি হতো بَشِّرُوا وَلَا تُنْذِرُوا، وَاسْتَأْنِسُوا وَلَا تُنَفِّرُوا অর্থাৎ সুসংবাদ দাও ভয় দেখাইও না, দয়াপরবশ হও, বিমুখ করিও না। তাহলে দেখা যায় এখানে সুসংবাদ প্রদান, সতর্কীকরণ, দয়াপরবশ ও বিমুখ করা সবগুলোকেই বুঝাচ্ছেন। তাই রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ইবারতই এখানে উপযুক্ত এবং তাঁর হাদীস থেকেও এটা বুঝা যায় যে, মানুষদেরকে সতর্ক করতে হবে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘‘তুমি কুরআনের মাধ্যমে সতর্ক কর তাদেরকে যারা ভয় করে’’ (আল-আন্‘আম ৬/১৫)। মানুষদেরকে জাহান্নামের শাস্তির ভয় দেখাতে গিয়ে এত বাড়াবাড়ি করা উচিত নয় যে, তারা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ে যায় তাদের পাপের কারণে। অথবা এটা বুঝানো হয়েছে যে, কল্যাণ লাভের উপর জোর দিয়ে আনুগত্যমূলক কাজ করতে উৎসাহিত করা হয়েছে। অত্যাচার কঠোরতার ভয় দেখিয়ে আল্লাহর আনুগত্য থেকে বিমুখ করে দিও না। (ফাতহুল বারী ১ম খন্ড, হাঃ ৬৯; শারহে মুসলিম ১২শ খন্ড, হাঃ ১৭৩২; ‘আওনুল মা‘বূদ ৮ম খন্ড, হাঃ ৪৮২৭; মিরকাতুল মাফাতীহ)
রাসূলুল্লাহ (সা.) নসীহতের বিষয়ে সংক্ষিপ্ত করতে এবং সালাতের ক্ষেত্রে লম্বা করতে বলেছেন। অপর হাদীসে এসেছে, ইবাদতের ক্ষেত্রে মধ্যমপন্থা অবলম্বন করতে বলেছেন। আবূ হুরাইরাহ (রাযি.) হতে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, إِنَّ الدِّينَ يُسْرٌ، وَلَنْ يُشَادَّ الدِّينَ أَحَدٌ إِلاَّ غَلَبَهُ، فَسَدِّدُوا وَقَارِبُوا وَأَبْشِرُوا، وَاسْتَعِينُوا بِالْغَدْوَةِ وَالرَّوْحَةِ وَشَىْءٍ مِنَ الدُّلْجَةِ ‘নিশ্চয়ই দ্বীন সহজ। দ্বীন নিয়ে যে বাড়াবাড়ি করে দ্বীন তার উপর জয়ী হয়। কাজেই তোমরা মধ্যপন্থা অবলম্বন কর এবং এর নিকটে থাক, আশান্বিত থাক এবং সকাল-সন্ধ্যায় ও রাতের কিছু অংশে (ইবাদাতের মাধ্যমে) সাহায্য চাও’ (বুখারী হা/৩৯, মিশকাত হা/১২৪৬)। সুতরাং ‘ইবাদাতে কঠোরতা অবলম্বন উচিত নয় বর এক্ষেত্রে মধ্যপন্থা অবলম্বন করা প্রয়োজন। দীনের কাজ প্রতিপালনের জন্য কঠোর সিদ্ধান্ত দেয়ার মাধ্যমে দীন থেকে মানুষকে দূরে রাখা যাবে না বরং তা সহজ করে তুলে ধরা এবং মানুষকে সুসংবাদ প্রদান করা উচিত। সকাল-সন্ধ্যা এবং শেষ রাতের ‘ইবাদাতের মাধ্যমে আল্লাহর নিকট সাহায্য কামনা করা উচিত।
হাদীসের শিক্ষা :
১. মুমিনের দায়িত্ব হলো , সে মানুষকে আল্লাহর সাথে সম্পৃক্ত করবে এবং কল্যাণকর কাজে উৎসাহিত করবে।
২. আল্লাহর দিকে আহ্বানকারীর জন্য আবশ্যক হলো, মানুষের কাছে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছানোর ক্ষেত্রে হিকমতের প্রতি লক্ষ্য রাখা।
৩. সহজতা ও সুসংবাদ দাওয়াত প্রদানকারী (দা‘য়ী) ও যাদেরকে দাওয়াত দেওয়া হয় (মাদ‘উ) তাদের সকলের জন্যে আনন্দ, গ্রহণযোগ্যতা ও প্রশান্তি সৃষ্টি করে।
৪. অন্যদিকে কঠোরতা দা‘য়ীর কথাবার্তায় বিদ্বেষ, বিমুখতা ও সংশয় সৃষ্টি করে।
৫. বান্দাহর প্রতি আল্লাহর প্রশস্ত রহমত। তিনি বান্দাহর জন্য সহনশীল ধর্ম এবং সহজ শরী‘য়ত মনোনীত করেছেন।
৬. এ হাদীসে বর্ণিত সহজতা বলতে সেগুলোকেই বুঝানো হয়েছে যেগুলো ইসলামী শরী‘য়ত নিয়ে এসেছে।
আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে দ্বীনের সঠিক বুঝ এবং অবিচল থাকার তাওফীক্ব দান করুন আমীন।